২৪ আগস্ট, ২০০৮

ভারতীয় জুজুর কাল্পনিক ধুয়া

’৭৫ এর ট্র্যাজেডি ॥ মার্কিন দলিলে -৪
অজয় দাশগুপ্ত

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট নারকীয় হত্যাকাণ্ডে বাংলাদেশে রাজনৈতিক ক্ষমতার পরিবর্তনের পর থেকেই রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাক আহমদ এবং তার সহচররা বাংলাদেশে ভারতীয় হস্তক্ষেপের সম্ভাবনার কথা বলতে থাকে। বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার মধ্য দিয়ে ক্ষমতাসীন কর্তৃপক্ষ যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য দেশের প্রতি নতুন সরকারকে দ্রুত স্বীকৃতি প্রদানের অনুরোধ জানায় এ যুক্তিতে যে, এর ফলে ভারত বাংলাদেশে সামরিক অভিযান চালানো থেকে বিরত হবে। পাকিস্তান ১৫ আগস্টেই খন্দকার মোশতাক আহমদের সরকারকে স্বীকৃতি জানানোর পেছনেও একই অজুহাত দেখায়। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দফতর এবং ভারতে অবস্থিত তার দূতাবাসও বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে সৈন্য চলাচলের ওপর সতর্ক নজর রাখে।

প্রকৃত পরিস্থিতি কী ছিল সেটা কি তারা জানত না, এ প্রশ্ন উঠতেই পারে।
১৯৭৫ সালের ২৬ আগস্ট বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতীয় দূতাবাসের প্রথম সচিব রণেন সেন ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাসের কর্মকর্তাদের সঙ্গে দেখা করেন।

ঢাকাস্থ যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত ২৭ আগস্ট ওয়াশিংটনে পররাষ্ট্র দফতরে যে বার্তা পাঠিয়েছেন তাতে বলা হয় : রণেন সেন জানান, ‘বাংলাদেশে ভারতের একমাত্র স্বার্থ হচ্ছে স্থিতিশীলতা বজায় রাখা। এখানে কী ধরনের সরকার ক্ষমতায় কিংবা কী অর্থনৈতিক নীতি অনুসরণ করা হচ্ছে তা নিয়ে ভারতের মাথাব্যথা নেই। তবে যদি হিন্দুরা মনে করে যে তাদের ওপর হুমকি সৃষ্টি হয়েছে এবং ভারতে আশ্রয়লাভের চেষ্টা চালায়, সেটা ভারতের জন্য গভীর উদ্বেগের কারণ হবে।’
বোস্টার তার প্রতিবেদনে বলেন, ‘অভ্যুত্থান ঢাকাস্থ ভারতীয় হাইকমিশনকে সম্পূর্ণ বিঘ্নিত করে। অভ্যুত্থানের সকালে ভারতীয় হাইকমিশন অফিস এবং এর স্টাফদের বাসস্থানগুলোর সব টেলিফোন সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়। ঢাকায় ভারতীয় অভিমত হচ্ছে, অভ্যুত্থান যে নিঁখুতভাবে সংঘটিত হয়েছে তাতে স্পষ্ট যে কিছু বৈদেশিক শক্তির অবশ্যই সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। এ ঘটনায় কোন বিদেশি শক্তি জড়িত সে বিষয়ে রণেন সেন কারো নাম বলেননি।’

এ সাক্ষাৎকার প্রসঙ্গে বোস্টারের মন্তব্য : ঢাকায় ভারতীয়রা ভারতের প্রতি বাঙালিদের মনোভাবের গভীরতা উপলব্ধি করে এবং ভারতের অভিপ্রায় নিয়ে অব্যাহত জল্পনা-কল্পনা রয়েছে সেটাও তারা জানে। আমরা মনে করি, ‘বাঙালিরা যে ভীতির (ভারতের তরফে) মধ্যে রয়েছে বলে অব্যাহতভাবে আমাদের কাছে জানাচ্ছে সেটা দূর করার জন্যই রণেন সেন আমাদের কাছে এসব কথা বলেছেন। সম্ভবত তারা এটাও চেয়েছে যে, আমরা তা বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে দেই।’

বঙ্গবন্ধু সরকারের বিরুদ্ধে যে চক্রান্ত হচ্ছে সেটা নিশ্চিতভাবেই ভারত জানত। যেমন জানত যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃপক্ষ। ১৭ আগস্ট যুক্তরাষ্ট্র পররাষ্ট্র দফতর তাদের বিভিন্ন দূতাবাসের জন্য যে সারসংক্ষেপ প্রেরণ করে তাতে ‘বাংলাদেশে অভ্যুত্থানের বিষয়ে ভারতের প্রতিক্রিয়া’ অংশে বলা হয় : ১৬ আগস্ট নয়াদিল্লিতে ভারতের একজন কর্মকর্তা নয়াদিল্লিস্থ মার্কিন দূতাবাসকে জানায়, ভারত সরকার কয়েক মাস আগেই একদল হতাশ ও ক্ষুব্ধ রাজনীতিক এবং খন্দকার মোশতাক আহমদ ও মুজিব কর্তৃক সম্প্রতি পদচ্যুত একজন ক্যাপ্টেনের নেতৃত্বে সামরিক অফিসারদের অভ্যুত্থান পরিকল্কপ্পনা জানতে পেরেছিল। এ সময়ে ওই কর্মকর্তা আরো জানান, তারা নতুন সরকারের পররাষ্ট্রনীতি বিশেষ করে পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে খন্দকার মোশতাক আহমদের সুপরিচিত অবস্থানের বিষয় নিয়ে উদ্বিগ্ন। ভারতে যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাস সংবাদপত্র সূত্রে জেনেছে, ইন্দিরা গান্ধীর সরকার ঢাকায় অভ্যুত্থানের বিষয়ে সম্পাদকীয় মন্তব্য লেখায় সেন্সরশিপ আরোপ করেছে। (ভারতে ওই সময়ে জরুরি আইন বলবৎ ছিল)।

১৮ আগস্ট নয়াদিল্লিস্থ যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাস জানায় : ‘কলকাতায় বাংলাদেশ সীমান্তের কাছে বসবাসকারী সূত্রের উল্লেখ করে জানায়, সীমান্ত এলাকায় ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ) এবং সম্ভবত নিয়মিত সেনাবাহিনীর শক্তি বৃদ্ধি করা হয়েছে। এর উদ্দেশ্য সম্ভবত বাংলাদেশে অভ্যুত্থানের পর হিন্দু শরণার্থীদের আগমন বন্ধ করা। কলকাতায় অনেক গুজব শোনা যাচ্ছে। কিন্তু প্রাপ্ত তথ্য থেকে এ উপসংহারে পৌঁছানো যায় যে, সামরিক বাহিনীর চলাচল যে মাত্রাতেই ঘটে থাকুক না কেন তার উদ্দেশ্য পশ্চিমবাংলায় শরণার্থী প্রবেশ ঠেকানো এবং কোনোভাবেই বাংলাদেশে ভারতীয় সামরিক হস্তক্ষেপের প্রস্তুতি নয়।’

নয়াদিল্লিস্থ দূতাবাস আরো জানায় : ১৫ আগস্টেই পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী (সিদ্ধার্থ শংকর রায়) শরণার্থী অনুপ্রবেশ ঠেকাতে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। তিনি বাংলাদেশে হিন্দু-মুসলিম সংঘাত বিষয়ে কিছু প্রকাশ না করার জন্য অনুরোধ করেন।

যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাস ওয়াশিংটনকে আরো জানায় : বাংলাদেশে ভারতীয় সেনা হস্তক্ষেপের প্রস্তুতি বিষয়ে দিল্লিতে কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। কলকাতায় মার্কিন কনসাল জেনারেলের এক প্রশ্নের উত্তরে ভারতীয় সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডার জেনারেল জ্যাকব ১৬ আগস্ট জানান : ভারতীয় সেনাবাহিনী বিশেষ কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করছে না।

জেনারেল জ্যাকবের মন্তব্য : ১৬ আগস্ট জেনারেল জ্যাকব এক ডিনার পার্টিতে ভারতে মার্কিন দূতাবাসের এক কর্মকর্তার কাছে বাংলাদেশের ঘটনাবলির বিষয়ে জানতে চান। এ ব্যাপারে কলকাতাস্থ মার্কিন কনসাল জেনারেলের কাছে যে রিপোর্ট রয়েছে সেটা তাকে অবহিত করে বলি, এ পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্যে প্রতীয়মান হয়, অভ্যুত্থান তেমন বিরোধিতা ছাড়াই সংঘটিত হয়েছে এবং পরিস্থিতি এখন শান্ত। জ্যাকব বলেন, তিনি ঢাকায় নয়, আশপাশের জেলাগুলোতে উল্লেখযোগ্য লড়াইয়ের বিষয়ে শুনেছেন।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিবেদনে বলা হয় : জ্যাকব অভ্যুত্থানকে নিন্দনীয় বলে মনে করেন। তিনি বলেন, এখন বাংলাদেশে কোনো স্থিতিশীলতা থাকবে না। পাল্টা অভ্যুত্থান ও সংঘর্ষের আশঙ্কাও রয়েছে। তিনি বাংলাদেশকে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ঘোষণার বিষয়ে ঢাকার নতুন প্রশাসনের অভিপ্রায় বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন। তার কাছে ভারতে বাংলাদেশ থেকে কোনো হিন্দু শরণার্থী আগমনের বিষয়ে কোনো তথ্য আছে কি-না জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, এ বিষয়টি এখনই বলা যাচ্ছে না। ভারতীয় সেনাবাহিনী কোনো বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করছে কি-না জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, বিশেষ কিছু না।

কলকাতায় ভারতীয় কনসুলেট অফিসের এক কর্মকর্তা ১৬ আগস্ট ওয়াশিংটনে জানান : বাংলাদেশের অভ্যুত্থানের বিষয়ে যাদের সঙ্গে কথা হয়েছে তারা সবাই এ ঘটনার নিন্দা জানান। তবে তাদের কেউই মনে করেন না যে, ভারতের বাংলাদেশ দখল করে নেওয়া উচিত।

নেপালে যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাস থেকে ওয়াশিংটনে ২৫ আগস্ট যে বার্তা পাঠানো হয় তাতে বলা হয় : রাজা থেকে সাধারণ মানুষ পর্যন্ত সবাই জানতে চায় বাংলাদেশের ঘটনাবলিতে ভারত কতটা জড়িত হবে। ভারতের প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপ ঘটবে কি-না সেটাও তারা জানতে চায়। আমরা তাদের বলছি, সাম্প্রদায়িক হানাহানি না ঘটা এবং প্রতিদ্বন্দী সামরিক ইউনিটগুলোর মধ্যে সংঘাত না ঘটায় বর্তমান সময়ে ভারতের হস্তক্ষেপের সম্ভাবনা খুব কম। নেপালিরা বাংলাদেশে ক্ষমতা পরিবর্তনে যুক্তিসঙ্গতভাবেই সন্তুষ্ট। নেপাল সরকার চীন ও পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে মোশতাক সরকারের উদ্যোগকে স্বাগত জানায়। তবে নেপালিরা মুজিব এবং তার পরিবারের সদস্যদের নির্মমভাবে হত্যার নিন্দা করে।

ইন্দিরার কাছে মোশতাকের বার্তা : ২৬ আগস্ট নয়াদিল্লিস্থ ভারতীয় রাষ্ট্রদূত ওয়াশিংটনে জানান, ২৫ আগস্ট ভারতে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এবং বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাক আহমদের একটি বার্তা হস্তান্তর করেন। এতে বাংলাদেশের নেতা বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য দুই দেশের যৌথ সংগ্রামের কথা উল্লেখ করেন। তিনি ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে সম্পাদিত দ্বিপক্ষীয় চুক্তির প্রতি বাংলাদেশ সম্মান জানাবে বলে জানান।
রাষ্ট্রদূতের কাছে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপনে ভারতের আগ্রহের কথা ব্যক্ত করেন।
২৭ আগস্ট বাংলাদেশে নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত বোস্টার যুক্তরাষ্ট্রকে জানান : ভারত সরকার বাংলাদেশের বিরুদ্ধে বৈরী প্রচারণার জন্য ভারতীয় সুবিধা ব্যবহার করতে না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। জানা গেছে, ভারতের তথ্যমন্ত্রী শুক্লা ২৪ আগস্ট বিদেশি সাংবাদিকদের জানান, আমরা আমাদের সুবিধাদি আমাদের বাংলাদেশের বন্ধুদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করতে দিতে চাই না। তিনি বাংলাদেশের ঘটনাবলি ভারতে প্রচারের বিষয়ে কিছু বিধি-নিষেধ আরোপের বিষয়েও বিদেশি সাংবাদিকদের অবহিত করেন।

এরই ধারাবাহিকতায় ২৭ আগ¯দ্ব খন্দকার মোশতাক আহমদ সরকারের প্রতি আসে ভারত সরকারের কাঙ্ক্ষিত স্বীকৃতি। ২৮ আগস্ট নয়াদিল্লিস্থ ভারতীয় দূতাবাস ওয়াশিংটনকে জানায় : ২৭ আগস্ট বিদেশ মন্ত্রণালয়ের একজন মুখপাত্র ঢাকার নতুন শাসকদের প্রতি ভারতের স্বীকৃতি প্রদানের বিষয়ে অবহিত করেন।
এর মধ্য দিয়ে ১৫ আগস্টের অভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশে ভারতের ভূমিকা কী হবে সেটা নিয়ে জল্লনা-কল্পনার অবসান ঘটবে বলে ধারণা হতে পারত। কিন্তু পরবর্তী তিন দশকের বেশি সময়েও সেটা ঘটেনি। বাংলাদেশে ভারত সর্বদাই একটি ফ্যাক্টর রয়ে গেছে। বিশেষ করে অভ্যন্তরীণ রাজনীতির নানা সমীকরণে তাদের বারবার টেনে আনার জন্য একটি মহল বরাবরই সক্রিয়। এ ক্ষেত্রে ভারতকে কখনো কখনো এমন অবস্থানে রাখা হয়, যার সঙ্গে বাস্তবের মিল থাকে সামান্যই। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর বাংলাদেশে ভারত সামরিক হস্তক্ষেপ করতে চলেছে বলে যে জুজু দেখানো হয়, সেটা ছিল এ ধরনেরই।
---------
সমকাল ১৬ আগস্ট

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

জনপ্রিয় পোস্টসমূহ