১৫ ডিসেম্বর, ২০০৮

শ্রীরামসি ও রানীগঞ্জের নির্মম হত্যাযজ্ঞের স্মৃতি আজো কাঁদায় জগন্নাথপুরবাসীকে

পাকিস্তানি হানাদারদের হাতে শহীদ হন ১৫৪ বাঙালি

সুনামগঞ্জ প্রতিনিধি : মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ১৯৭১ সালের ৩১ আগষ্ট সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুর উপজেলার শ্রীরামসি গ্রামে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী যে জঘন্যতম গণহত্যা চালিয়েছিল তা আজও সবার মনে শিহরণ জাগায়। দুটি গ্রাম মিলিয়ে সেদিন পাকিস্তানি হানাদারদেও হাতে নির্মমভাবে শহীদ হন ১৫৪ জন।
এলাকাবাসী জানান, ৩১ আগস্ট বেলা ১০টার দিকে কয়েকটি নৌকা যোগে পাকিস্তানি সেনারা শ্রীরামসি বাজারে এসে আলবদর আল শামসদের এলাকার লোকদের বিদ্যালয়ে উপস্থিত করার জন্য নির্দেশ দেয়। পাকিস্তানি বাহিনীর নির্দেশে দেশীয় রাজাকাররা এলাকার সচেতন ও শিক্ষিত অশিক্ষিত যুবকদের ডেকে একটি রুমে জড়ো করে। সেখানে সবার হাত পেছনে নিয়ে বেঁধে ফেলা হয়। পরে শতাধিক শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী ও যুবককে বেঁধে নৌকায় নিয়ে গিয়ে এক সঙ্গে এলোপাতাড়ি গুলি ছুঁড়ে হত্যা করে পাকিস্তানি হানাদাররা। অন্যান্য দলকেও একইভাবে বেঁধে পার্শ্ববর্তী পুকুর পারে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে ব্রাশ ফায়ার করে পাষাণের মতো হত্যা করে নরপিশাচরা। আহত হয়ে যারা কোনো রকমে বাঁচার তাগিদে পুকুরে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন তাদের ওপরও পুকুর পার থেকে গুলি ছুঁড়ে কাপুরুষের মতো হত্যা করা হয়। শুধুমাত্র বয়সে যারা খুবই বৃদ্ধ তাদের প্রায় অক্ষত অবস্থায় ছেড়ে দেয় হানাদাররা। কেউ কেউ নরপশুদের অত্যাচার থেকে প্রাণ বাঁচাতে গ্রাম ছেড়ে অন্যত্র পালাতে সক্ষম হন।
পাকিস্তানি হানাদারদের নিষ্ঠুর এ হত্যাকাণ্ডে শহীদ হন ১২৪ জন বিভিন্ন বয়স ও পেশার লোক। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছেন শিক্ষক তহশিলদার, পোস্টমাস্টার, ডাক পিয়ন, ইউপি মেম্বার, ছাত্র যুবক, বৃদ্ধ, প্রবাসী ও বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষ। গুটি কতক আহত হয়ে বেঁচে যান। ঘাতকেরা এ বর্বর পৈশাচিক গণহত্যার পরও ক্ষান্ত হয়নি। শুর" করে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ। শ্রীরামসি বাজারে কেরোসিন তেল ছিটিয়ে প্রায় আড়াইশ থেকে তিনশ ঘরবাড়ি দোকানপাট জ্বালিয়ে দেয়। গুলির শব্দে ও আগুনের লেলিহান শিখা দেখে গ্রামবাসী ছুটে পালান। জনশূণ্য অবস্থায়ও পাকিস্তানি হানাদাররা গ্রামে হামলা চালিয়ে ঘরবাড়ি পুড়িয়ে ফেলে। হানাদার সৈন্যরা চলে যাওয়ার পর চারদিকে মৃতদেহ ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে থাকে। ভয়ে আতঙ্কে পালিয়ে যাওয়া গ্রামবাসীর কেউই প্রায় সপ্তাহ খানেক গ্রামে ফেরেননি। তখন শিয়াল, কুকুর ও শকুনেরা লাশ নিয়ে টানাটানি শুর" করে। এরপর আস্তে আস্তে লোকজন গ্রামে এসে ৪/৫ টি করে মৃতদেহ একেক গর্তে কবর দেন। শ্রীরামসি বধ্যভুমিতে শায়িত শহীদদের মধ্যে ৩৪ জনের নাম জানা গেছে। তারা হলেন মৌলানা আব্দুল হাই, সত্যেন্দ্র নাথ চক্রবর্তী, এহিয়া চৌধুরী, আশরাফ হোসেন, শফিকুর রহমান, ফিরোজ মিয়া, সুনু মিয়া, আলা মিয়া, সমুজ মিয়া, নজির মিয়া, আব্দুল মন্নান, ওয়ারিছ মিয়া, মানিক মিয়া, আব্দুল জলিল, দবির মিয়া, মরম উল্লাহ, মন্তাজ আলী, সওয়াব উল্লাহ, রইছ উল্লাহ, আব্দুল মজিদ, আব্দুল লতিফ, এখলাছ মিয়া, মোক্তার মিয়া, সমীর আলী, জহুর আলী, নুর মিয়া, আব্দুল মন্নান, আছা মিয়া, তৈয়ব আলী, রোয়াব আলী, মছদ্দর আলী, তোফাজ্জল আলী, ডা. আব্দুল মন্নান এবং রুপু মিয়া। অন্যান্য শহীদদের নাম পাওয়া যায়নি। গুলিবিদ্ধ হয়েও ঘটনাক্রমে ৮ জন বেঁচে যান। তারা হচ্ছেন জোয়াহির চৌধুরী, আলকাছ মিয়া, কফিল উদ্দিন, তপন চক্রবর্তী, সুন্দর আলী, আমজাদ আলী ও জাফর মিয়া। তারা আজো সেদিনের ঘটনার কথা মনে করে আঁতকে ওঠেন। ইতিহাসের কলঙ্কজনক ও জঘন্যতম এ গণহত্যার সংবাদ এ সময় বিবিসি থেকে প্রচার করে বিশ্ববাসীকে জানানো হয়। একই সময়ে জগন্নাথপুর থানার রাণীগঞ্জ বাজারেও তাণ্ডবলীলা চালায় পাকিস্তানি হানাদাররা। কিছুসংখ্যক আলবদর আলশামস ও রাজাকারদের সাহায্যে বাজারে আগুন জ্বালিয়ে দোকান ঘরবাড়ি ছারখার করে দেয় তারা। নৃশংসভাবে হত্যা করে ৩০ জনের মতো নিরীহ ও শান্তিপ্রিয় বাঙালিকে। মারাত্মক আহত হয়েও বেঁচে যান ৫ জন। প্রায় ২০০ দোকানপাট ভস্মীভূত হয়।
নিষ্ঠুর সে হত্যাযজ্ঞের শহীদদের স্মরণে শ্রীরামসি উচ্চ বিদ্যালয় প্রাঙ্গনে স্থানীয় মুক্তি সংগ্রাম স্মৃতি ট্রাস্ট একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মিত করেছে। প্রতি বছর এখানে শহীদদের স্মরণে বিভিন্ন অনুষ্ঠানমালার আয়োজন করা হয়। তবে শ্রীরামসি গ্রামকে শহীদনগর নামকরণ করতে এলাকাবাসী দীর্ঘদিন ধরে দাবি জানালেও তা আজো বাস্তবায়িত হয়নি।

সূত্র: ভোরের কাগজ, ১৫ ডিসেম্বর, ২০০৮

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

জনপ্রিয় পোস্টসমূহ