২৭ ডিসেম্বর, ২০০৮

নির্বাচনে যুদ্ধাপরাধী প্রার্থীরা- ০৮

আবদুস সুবহান মিয়া

সমকাল প্রতিবেদক

পাবনা শহরের পাথরতলা মহল্লার মৃত নইমুদ্দিনের ছেলে আবুল বসর মোহাম্মদ আবদুস সুবহান মিয়া এবারের সংসদ নির্বাচনে পাবনা-৫ (সদর) আসনে জামায়াত তথা চারদলীয় জোট প্রার্থী। জামায়াতের সংসদীয় দলের এই সাবেক উপ-নেতা ‘মাওলানা সুবহান’ নামেই বেশি পরিচিত। তার বিরুদ্ধে রয়েছে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে সহযোগিতা, বুদ্ধিজীবী হত্যা ও গণহত্যার সুনির্দিষ্ট অভিযোগ।

১৯৭১ সালে তিনি ছিলেন পাবনা জেলা জামায়াতের ভারপ্রাপ্ত আমির। তাছাড়া তিনি ছিলেন পাবনা শান্তি কমিটির ভাইস প্রেসিডেন্ট। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর অত্যন্ত আস্থাভাজন একজন সহযোগী ছিলেন তিনি। উর্দুতে কথা বলতে পারায় মাওলানা সুবহানের সঙ্গে পাকিস্তানি সেনাদের খুব তাড়াতাড়ি সখ্য গড়ে উঠেছিল বলে মনে করা হয়। তার ইঙ্গিতে পাবনা শহরের শত শত মানুষকে পাকবাহিনী হত্যা করে। ‘একাত্তরের ঘাতক দালাল ও যুদ্ধাপরাধীদের সম্পর্কে জাতীয় গণতদন্ত কমিশনের দ্বিতীয় রিপোর্ট’-এ (সংক্ষিপ্ত ভাষ্য) বলা হয়, ‘মাওলানা সুবহানের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় পাবনার আল বদর, রাজাকার এবং শান্তি কমিটি গঠিত হয়। মাওলানা সুবহান উর্দু ভাষায় অনর্গল কথা বলতে পারতেন বলে পাকিস্তানি বাহিনীর খুব কাছাকাছি আসতে সমর্থ হন এবং নীতিনির্ধারক হিসেবে স্বাধীনতা যুদ্ধবিরোধী ভূমিকায় তার সার্বিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করেন।’

স্থানীয় সাংবাদিক শফিকুল ইসলাম শিবলী জানান, বীর মুক্তিযোদ্ধা মাওলানা কসিমুদ্দিনকে মাওলানা সুবহানের নির্দেশে হত্যা করা হয়। এছাড়া পাবনার এডওয়ার্ড কলেজের প্রফেসর হারুন, ডাক্তার অমলেন্দু দাক্ষি, সাবেক এমএনএ এবং আওয়ামী লীগ নেতা আমিনুদ্দিন, ব্যবসায়ী আবু সাইদ তালুকদারকে মাওলানা সুবহানের নির্দেশেই হত্যা করা হয়। এছাড়া মাওলানা সুবহানের লোকজন সঙ্গীতশিল্পী সাধনকে ধরে নিয়ে গিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করে। পাবনা শহরের কালাচাঁদপাড়া এলাকায় মাওলানা সুবহানের নেতৃত্বে সুধীর চন্দ্র চৌধুরী, অশোক কুমার সাহা, গোপাল চন্দ্র চৌধুরীসহ ১১ ব্যক্তিকে গুলি করে হত্যা করা হয় বলে জানান শফিকুল ইসলাম শিবলী।

পাবনা জেলা বিএনপির সিনিয়র সহ-সভাপতি মুক্তিযোদ্ধা জহুরুল ইসলাম বিশু বলেন, ১৯৭১ সালের মে মাসের প্রথম সপ্তাহে মাওলানা সুবহানের নেতৃত্বে সুজানগরের নাজিরগঞ্জে ৪০০ নিরীহ ব্যক্তিকে হত্যা করা হয়। পরে ওই হত্যাযজ্ঞের অন্যতম নায়ক রাজাকার মৌলভী মধুকে মুক্তিযোদ্ধারা ধরে নিয়ে হত্যা করে। মৃত্যুর আগে মৌলভী মধু মুক্তিযোদ্ধাদের বলেন, পাবনা জেলায় যত হত্যাকা- হয়েছে তার সবই হয়েছে মাওলানা সুবহানের নির্দেশে। এছাড়া সুবহানের নেতৃত্বে ফরিদপুর উপজেলার ডেমরায় প্রায় ১ হাজার নিরীহ মানুষকে হত্যা করা হয়। যুদ্ধে পরাজয় অবধারিত বুঝতে পেরে ১৯৭১ সালের ৪ ডিসেম্বর মাওলানা সুবহান পাকিস্তান হয়ে সৌদি আরব পালিয়ে যান। মাওলানা আবদুস সুবহান সম্পর্কে গণতদন্ত রিপোর্টে আরো বলা হয়, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে মাওলানা সুবহানের বাংলাদেশের স্বাধীনতা, বাঙালি জাতিসত্তাবিরোধী ভূমিকা, মুক্তিযোদ্ধাদের সমূলে ধ্বংস করার লক্ষ্যে আলবদর, রাজাকার, শান্তি কমিটি গঠন করে ৩০ লাখ নিরীহ, নিরস্ত্র, শান্তিকামী মানুষ হত্যায় সহায়তা এবং পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর যাবতীয় নৃশংস কার্যকলাপে সহায়তার জন্য তার বিরুদ্ধে ’৭২ সালে স্পেশাল ট্রাইব্যুনালে মামলা রুজু করা হয়। ২৯ ফেব্রুয়ারি, ১৯৭২ সালে বিকেল ৩টায় তাকে পাবনার মহকুমা ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে হাজির হতে বলা হয়। কিন্তু সে সময় তিনি গোলাম আযমের সঙ্গে পাকিস্তান পালিয়ে গিয়েছিলেন। (সূত্র : ‘একাত্তরের দালালরা’ : শফিক আহমেদ এবং অ্যাডভোকেট শফিকুল ইসলাম শিবলী, পাথরতলা, পাবনা)। ’৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে রাজধানী ঢাকার মতো পাবনাতেও পাকিস্তান বাহিনী অতর্কিতে নিরীহ বাঙালির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। তবে পাবনার অবস্থা ছিল একটু ব্যতিক্রম। তদন্তকালে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক প্রত্যক্ষদর্শী একজন মধ্যবয়স্ক মহিলা জানান, ’৭১ সালের ২৫ মার্চ রাত থেকেই পাবনার গণ্যমান্য বরেণ্য ব্যক্তিদের স্থানীয় দালালদের সহযোগিতায় পাকিস্তানি আর্মি বাড়ি বাড়ি গিয়ে ধরে নিয়ে আসে। ২৬ মার্চ বিকেল আনুমানিক ৩টার ঘটনা। একজন মহিলা তখন পাবনা রায়েরবাজারের প্রধান সড়কের ধারে একটি পুরনো বাড়ির দোতলার জানালায় দাঁড়িয়ে ছিলেন। জানালার খড়খড়ি দিয়ে দেখছিলেন ভীত-সন্ত্রস্ত পাবনা শহর। হঠাৎ তিনি পাকিস্তানি আর্মির একটি লরি রাস্তার ওপর থামতে দেখেন। লরির পেছনে লম্বা দড়ি দিয়ে বাঁধা প্রায় ১০০ মানুষ, যাদের পাকা রাস্তার ওপর দিয়ে টেনে আনা হয়েছে। প্রত্যেক বন্দির জামা-কাপড় ছিন্নভিন্ন, তাদের হাঁটু থেকে পায়ের পাতা পর্যন্ত সাদা হাড় দেখা যাচ্ছিল আর শরীর ছিল রক্তে মাখামাখি। লরির ভেতরে তিনি পাকিস্তানি আর্মিদের সঙ্গে মাওলানা আবদুস সুবহানকে বসা দেখেছিলেন তিনি। আর যাদের সিমেন্টের রাস্তার ওপর দিয়ে টেনেহেঁচড়ে আনা হচ্ছিল তাদের মধ্যে তিনি পাবনার বিশিষ্ট ব্যবসায়ী আবু সাঈদ তালুকদার, এডওয়ার্ড কলেজের প্রফেসর হারুন, বিশিষ্ট দন্ত চিকিৎসক অমলেন্দু দাক্ষি এবং অ্যাডভোকেট ও আওয়ামী লীগের নেতা আমিনউদ্দিনকে চিনতে পেরেছিলেন। লরি থেকে নেমে কিছু সৈন্য কয়েকটি দালানের ওপর ওড়ানো বাংলাদেশের পতাকা নামানো এবং পোড়ানোর ব্যবস্থা করে চলে যায়। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক, ভীতসন্ত্রস্ত ওই মহিলা জানান, ২৯ মার্চ ’৭১ সালের মধ্যে তার দেখা ওইসব পরিচিত ব্যক্তির সবাইকে মেরে ফেলা হয়। তিনি আরো বলেন, ২৬ তারিখে এ দৃশ্য দেখার পর ২৭ মার্চ অমলেন্দু দাক্ষির বাড়িতে গিয়ে তার স্ত্রীর কাছ থেকে জানতে পারেন, দন্ত চিকিৎসক অমলেন্দু দাক্ষির বাড়িতে মাওলানা আবদুস সুবহান পাকিস্তানি আর্মিদের নিয়ে এসেছিলেন।

পাবনা জজকোর্টের সিনিয়র অ্যাডভোকেট, সাবেক পাবলিক প্রসিকিউটর এবং আওয়ামী লীগের প্রধান নেতা আলহাজ গোলাম হাসনায়েন (কাচারীপাড়া, পাবনা) বলেন, ‘মাওলানা আবদুস সুবহান আওয়ামী লীগ নেতা আমিনউদ্দিন সাহেবের বাসা পাক আর্মিদের চিনিয়ে দিয়েছিল।’ তিনি আরো বলেন, ‘পাবনার আলবদর, রাজাকার, শান্তি কমিটির সব সদস্যকে মাওলানা সুবহান সংগ্রহ করেছিলেন।’

অবসরপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মোঃ আবদুল গনি (কালাচাঁদপাড়া, পাবনা) জানান, ‘১৭ এপ্রিল দুপুরে হিন্দু অধ্যুষিত এলাকা কুচিয়াপাড়া ও শাঁখারীপাড়ায় মাওলানা আবদুস সুবহান পাকিস্তানি আর্মিদের সঙ্গে নিয়ে অপারেশন চালান। ওইদিন সেখানে সুধীরচন্দ্র চৌধুরী, অশোক কুমার সাহা, গোপালচন্দ্র চৌধুরীসহ ৮ জনকে হত্যা করা হয়। তারা ২০/২৫টি ঘর পোড়ানো এবং সে সঙ্গে লুটতরাজ ও নারী নির্যাতনও করেছিল।’ অধ্যক্ষ আবদুল গনি আরো বলেন, ‘মে মাসে পাবনা-ফরিদপুর থানার ডেমরাতে মাওলানা আবদুস সুবহান, মাওলানা ইসহাক, টেগার ও আরো কয়েকজন দালালের একটি শক্তিশালী দল পাকিস্তানি আর্মিকে নিয়ে ব্যাপক গণহত্যা করে। সেখানে ওইদিন আনুমানিক ১০০০ মানুষ হত্যাসহ ঘরবাড়ি পোড়ানো, লুণ্ঠন, নারী নির্যাতন ইত্যাদি করা হয় (সূত্র : গণতদন্ত কমিশন রিপোর্ট)।

পাবনার দ্বিতীয় বৃহত্তম গণহত্যাটি হয় সুজানগর থানায়। ‘মে মাসের প্রথমদিকে এক ভোরে নাজিরগঞ্জ-সাতবাড়িয়া ইউনিয়নের হত্যা করা হয় প্রায় ৪০০ জনকে’- বলেন মুজিব বাহিনীর সুজানগর থানা লিডার এবং ঢাকার ব্যবসায়ী জহিরুল ইসলাম বিশু। তিনি জানান, সুজানগর হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ও শান্তি কমিটির একজন সদস্য মৌলভী মধুকে তারা ’৭১-এর মে মাসের শেষদিকে গ্রেফতার করেন এবং পরে মেরে ফেলেন। জিজ্ঞাসাবাদের সময় এই ঘাতক জানিয়েছিলেন, ‘সুজানগর অপারেশনের আগের দিন পাথরতলায় আবদুস সুবহানের বাসায় মিটিং হয়েছিল এবং মিটিংয়ে সুজানগর অপারেশনের পরিকল্পনা নেওয়া হয়।’ পাবনার যে কোনো অপারেশনের আগে মাওলানা সুবহানের বাসায় পরিকল্পনা করা হতো বলে জহিরুল ইসলাম বিশু গণতদন্ত কমিশনকে জানান। অভিযোগ রয়েছে, বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে পাবনায় জামায়াতের দখলদারিত্ব ও লুটপাটের রাজত্ব চলে। ক্ষমতার অপব্যবহার করে শহরে ৫ কোটি টাকার ৩ একর জায়গা মাত্র ৭৪ লাখ টাকায় জামায়াতকে দেওয়া হয়। সেখানে ইমাম গাযযালী স্কুল অ্যান্ড কলেজ নামে জামায়াতের একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয়। এছাড়া জামায়াত ক্যাডাররা পাবনায় বাংলা চলচ্চিত্রের কিংবদন্তি অভিনেত্রী সুচিত্রা সেনের পৈতৃকবাড়ি দখল করে ইমাম গাযযালী ইনস্টিটিউট গড়ে তোলে। তবে জামায়াত নেতাদের দাবি, তারা বাড়িটি লিজ নিয়ে সেখানে গাযযালী ইনস্টিটিউট করেছেন।

দৈনিক সমকাল, ১৮ ডিসেম্বর, ২০০৮

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

জনপ্রিয় পোস্টসমূহ