১৯ ডিসেম্বর, ২০০৮

নির্বাচনে যুদ্ধাপরাধী প্রার্থীরা- ০৩

আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ

নিজস্ব প্রতিবেদক, ফরিদপুর

জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ আসন্ন সংসদ নির্বাচনে ফরিদপুর-৩ আসনে চারদলীয় জোটের প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা ও বিশিষ্টজনরা জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল যুদ্ধাপরাধী মুজাহিদকে ভোট না দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, তার মতো কুখ্যাত রাজাকারকে জাতীয় সংসদে পাঠানো ফরিদপুরবাসীর উচিত হবে না। মুক্তিযুদ্ধের সময় মুজাহিদের স্বাধীনতাবিরোধী ভূমিকার কথা বহু দলিলে উল্লেখ রয়েছে।

সাবেক সাংসদ ও ফরিদপুর জেলা সেক্টর কমান্ডারস ফোরামের আহ্বায়ক প্রিন্সিপাল দেলোয়ার হোসেন সমকালকে বলেছেন, আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার বিপক্ষে বিশেষ ভূমিকা রেখেছিলেন। তিনি বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধকালে পত্রপত্রিকায় পড়েছি, রেডিওতে শুনেছি ও জেনেছি মুজাহিদ পাক বাহিনীর দোসর আলবদর বাহিনীর কমান্ডার ছিলেন।’ তিনি বলেন, ‘এ যুদ্ধাপরাধীকে পবিত্র সংসদে প্রবেশ করতে দেওয়া ঠিক হবে না।’

মুক্তিযোদ্ধা সংসদের ফরিদপুর জেলা ইউনিটের কমান্ডার আবুল ফয়েজ শাহনেওয়াজ বলেন, ‘মুজাহিদ ছিল আলবদর বাহিনীর ডেপুটি চিফ। এ বদর বাহিনীর নীলনকশা অনুযায়ী দেশের বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করা হয়েছে। সেক্টর কমান্ডারস ফোরামের ফরিদপুর জেলা কমিটির সদস্য সচিব শাহনেওয়াজ বলেন, ‘আমাদের সংগঠন প্রামাণ্য দলিল ও তথ্য প্রমাণের ভিত্তিতে মুজাহিদসহ ৫০ জন যুদ্ধাপরাধীর নামের তালিকা প্রকাশ করেছে।’
সেক্টর কমান্ডারস ফোরামের ফরিদপুর জেলা সমন্বয়কারী মুক্তিযোদ্ধা কাজী ফরিদ বলেন, ‘আলবদর বাহিনীর কমান্ডার মুজাহিদ ঘৃণিত ব্যক্তি। এরা বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের শত্রু এবং দেশকে পাকিস্তান বানানোর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। এ যাবৎ বাংলাদেশে যত অনাসৃষ্টি হয়েছে তার মূল হোতা এরাই।’

ফরিদপুরের বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি কাজী জায়নুল আবেদীন বলেন, ‘মুজাহিদসহ যেসব আলবদর, রাজাকার, যুদ্ধাপরাধী এবারের নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে, তাদের বিরুদ্ধে ভোট দিয়ে জনগণ উপযুক্ত জবাব দেবেন।’ তিনি আরো বলেন, ‘চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধীদের নির্বাচনে দাঁড়ানোর সুযোগ দিয়ে সরকার ও নির্বাচন কমিশন ঠিক করেনি। মুজাহিদসহ সব যুদ্ধাপরাধীর অবিলম্বে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানাই।’
ফরিদপুর জেলা কৃষক দলের সাধারণ সম্পাদক সরকারি রাজেন্দ্র কলেজের সাবেক জিএস আফজাল হোসেন খান পলাশ বলেন, ‘বিজয়ের এ মাসে নরঘাতক মুজাহিদকে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সুযোগ দেওয়াকে চরম ধৃষ্টতা মনে করি। এ যুদ্ধাপরাধীকে ফরিদপুরবাসী ভোটের মাধ্যমে প্রত্যাখ্যান করবে। ’

একাত্তরের ঘাতক দালাল ও যুদ্ধাপরাধীদের সম্পর্কে জাতীয় গণতদন্ত কমিশনের রিপোর্টে বলা হয়েছে, ‘আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ ’৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে দলীয় আদর্শ অনুযায়ী পাকিস্তান সেনাবাহিনীর গণহত্যা, লুটপাট ও নারী নির্যাতনে সহযোগিতা করেছেন। তার নেতৃত্বাধীন আলবদর বাহিনী বিজয়ের পূর্ব মুহূর্তে সুপরিকল্পিতভাবে হত্যা করেছে এ দেশের বরেণ্য বুদ্ধিজীবীদের। আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের স্বাধীনতাবিরোধী তৎপরতার বিবরণ পাওয়া গেছে সে সময়ের বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত তার বক্তৃতা-বিবৃতিতে।’ ১৯৭১ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর ফরিদপুরে ছাত্রসংঘের এক জমায়েতে ‘বিপুল করতালির মধ্যে’ আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ ঘোষণা করেন, ‘ঘৃণ্য শত্রু ভারত দখল করার প্রাথমিক পর্যায়ে আমাদেরকে আসাম দখল করতে হবে। এজন্য আপনারা সশস্ত্র প্রস্তুতি গ্রহণ করুন।’

রিপোর্টে আরো বলা হয়, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ ফকিরাপুল, নয়াপল্টন এলাকার বিভিন্ন বাড়িতে থাকতেন, তার মধ্যে একটি বাড়ি হলো : শেখ ভিলা, ৩/৫ নয়াপল্টন। তবে আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের প্রধান আড্ডা ছিল ফকিরাপুল গরম পানির গলিতে ফিরোজ মিয়ার ১৮১ নম্বর (বর্তমান ২৫৮ নম্বর) বাড়িটিতে। ’৭১-এ মতিঝিল, ফকিরাপুল এলাকার মুক্তিযুদ্ধের কমান্ডার বর্তমানে জাতীয় পার্টি নেতা আবদুস সালাম, মুক্তিযোদ্ধা ও সাংবাদিক জিএম গাউস, মুক্তিযোদ্ধা ও কলামিষ্ট মাহবুব কামালের সাক্ষ্য অনুযায়ী জানা গেছে, ফিরোজ মিয়া ছিলেন এ এলাকার রাজাকার কমান্ডার। তার বাড়িটি শুধু ফকিরাপুল এলাকার নয়, পুরো ঢাকা শহরের রাজাকারদের অন্যতম ঘাঁটি ছিল। এখানেই অনুষ্ঠিত হতো রাজাকারদের বিভিন্ন সভা, সশস্ত্র ট্রেনিং ইত্যাদি। এখান থেকেই পরিচালিত হতো রাজাকারদের বিভিন্ন অপারেশন, রাজাকার রিক্রুটমেন্ট। এখানে এলাকার মুক্তিযোদ্ধা এবং মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের শক্তির লোকদের ধরে এনে নির্যাতন চালানো হতো। ফিরোজ মিয়া গংয়ের নীতিনির্ধারক ছিলেন আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ। কেন্দ্রীয় নেতা হিসেবে তার নির্দেশেই পরিচালিত হতো ফকিরাপুল এলাকার মুক্তিযুদ্ধবিরোধী যাবতীয় তৎপরতা। জিএম গাউস বলেন, ’৭০-এর মাঝামাঝি সময় থেকেই আমরা ফকিরাপুল এলাকার ভাড়াটিয়া আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদকে চিনতাম জামায়াত ও ইসলামী ছাত্রসংঘের লোক হিসেবে। তিনি এলাকায় দলের সাংগঠনিক তৎপরতা চালাতেন। কেন্দ্রীয় সমাবেশে এলাকা থেকে মিছিল নিয়ে যেতেন। এলাকার ছেলেদের ছাত্রসংঘে যোগদানের ব্যাপারে প্ররোচিত করতেন। ’৭১-এর মার্চের পর মুজাহিদের সার্বিক তত্ত্বাবধানে ফকিরাপুলে রাজাকার বাহিনী সংগঠিত হয়। যার নেতৃত্বের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল ফিরোজ মিয়াকে (ফেরু মেম্বার)। মুজাহিদের সরাসরি নির্দেশেই পরিচালিত হয়েছে ফকিরাপুল এলাকায় রাজাকার বাহিনীর তৎপরতা, অস্ত্র ট্রেনিং, রিক্রুটমেন্ট ইত্যাদি। তিনি এলাকার রাজাকারদের অস্ত্র-অর্থ সংগ্রহসহ যাবতীয় দুষ্কর্মে সহযোগিতা করেছেন। মুক্তিযুদ্ধের মাঝামাঝি পর্যায়ে অত্র এলাকার মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক এবং স্বাধীনতার পক্ষের বুদ্ধিজীবীদের ধরে এনে অত্যাচার-নির্যাতন, এমনকি হত্যা করার উদ্দেশ্যে গঠিত আলবদর বাহিনীর নেতা ছিলেন আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ। জাতীয় পার্টি নেতা আবদুস সালাম বলেন, ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের সময় ফকিরাপুল গরম পানির গলির ফিরোজ মিয়ার বাড়িটি ছিল রাজাকারদের অন্যতম নির্যাতন কেন্দ্র। ফিরোজ মিয়া গংয়ের নীতিনির্ধারক বা পরামর্শদাতা ছিলেন আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ। অবশ্য কেন্দ্রীয় নেতা হিসেবে মুজাহিদের অপতৎপরতা শুধু ফকিরাপুল এলাকায় নয়, বিস্তৃত ছিল পুরো ঢাকা শহরে।’
গণতদন্ত কমিশনের রিপোর্টে বলা আরো হয়েছে, ‘মুজাহিদের রিক্রুট ফিরোজ মিয়া ফকিরাপুল এলাকার ৩০০ সদস্যের একটি রাজাকার প্লাটুন গড়ে তোলেন।’ ফকিরাপুল এলাকার পুরনো বাসিন্দাদের সাক্ষ্য থেকে জানা যায়, ‘ফিরোজ মিয়া গং যুদ্ধের সময় ফকিরাপুল ও আরামবাগ এলাকার শত শত বাঙালিকে ধরে নিয়ে হত্যা করেছে। নির্যাতন চালিয়েছে এলাকার মেয়েদের ওপর।’...

আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের স্বাধীনতাবিরোধী তৎপরতা ও নৃশংসতা ’একাত্তরেই শেষ হয়ে যায়নি। সেই মুজাহিদ সংসদ সদস্য হতে ভোটারদের দ্বারে দ্বারে হাজির হচ্ছেন।

শাহরিয়ার কবির সম্পাদিত “একাত্তরের যুদ্ধাপরাধী এবং ‘যুদ্ধাপরাধীদের বিচার’ শীর্ষক গ্রন্থে দীপু হোসেন তার নিবন্ধে উল্লেখ করেছেন, মহান মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী মুজাহিদ ১৯৭১ সালের অক্টোবরে মতিউর রহমান নিজামীর সঙ্গে দেশের বিভিন্ন স্থানে সাংগঠনিক সফর করেন। ২৫ অক্টোবর ইসলামী একাডেমী হলে প্রাদেশিক সদস্যদের এক সম্মেলনে মুজাহিদ তার বক্তব্যে পাকিস্তানের ছাত্র-জনতাকে দুষ্কৃতিকারী (মুক্তিযোদ্ধা) খতম করার দৃঢ় অঙ্গীকার নিয়ে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান (সূত্র : দৈনিক সংগ্রাম ২৬-১০-৭১)। একই মাসের ২৭ তারিখে রংপুর জেলা ছাত্রসংঘের সম্মেলনে প্রধান অতিথির বক্তব্যে মুজাহিদ সবাইকে জিহাদি মনোভাব নিয়ে পাকিস্তান বাহিনীর পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান জানান (সূত্র : দৈনিক সংগ্রাম ২৮-১০-৭১)। মতিউর রহমান নিজামী ও আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের নেতৃত্বাধীন আলবদর বাহিনী ১৯৭১ সালের শেষভাগে তাদের তৎপরতা বাড়িয়ে দেন এবং ১৪ নভেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে ঢাকায় ‘বদর দিবস’ পালন করেন।”

আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের বাবা মওলানা আবদুল আলী ছিলেন স্কুল শিক্ষক ও হেকিম। মুজাহিদের ভাই মোহাম্মদ খালেছ ফরিদপুর জেলা জামায়াতের নায়েবে আমির। তার এক ভাই মোহাম্মদ আসলাম ইসলামী ব্যাংক লিমিটেডের ভাইস প্রেসিডেন্ট, তার আরেক ভাই আলী আশরাফ সোয়ায়েব দৈনিক সংগ্রামের ফরিদপুর জেলা প্রতিনিধি। মুজাহিদের বড় ছেলে তাসদিদ রাজধানীর একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে চাকরি করেন। মেজ ছেলে তাহ্ফিক গ্রামীণফোনের একজন কর্মকর্তা এবং ছোট ছেলে মাবরুব রাজধানীতে অনুবাদকের কাজ করেন। তার একমাত্র মেয়ে তামরিনা ঢাকা ইডেন কলেজে অনার্স শেষ বর্ষের ছাত্রী।

মুজাহিদ অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র থাকা অবস্থায় ‘বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রসংঘে’ যোগদান করে রাজনৈতিক জীবন শুরু করেন। ১৯৬৪ সালে ফরিদপুর জিলা স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করে তিনি ফরিদপুর সরকারি রাজেন্দ্র কলেজে ভর্তি হন। কলেজ জীবনে তিনি জামায়াতের রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। এরপর তিনি ঢাকায় চলে যান।
স্বাধীনতা যুদ্ধের পর মুজাহিদ নারায়ণগঞ্জে আদর্শ কিন্ডারগার্টেন নামে একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে তিন বছর প্রধান শিক্ষক পদে ছিলেন। তার ভাই মোঃ খালেছ জানান, রাজনীতিতে জড়িত থাকা অবস্থাতেই মুজাহিদ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে এমএ করেছেন।

দৈনিক সমকাল, ১৮ ডিসেম্বর, ২০০৮

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

জনপ্রিয় পোস্টসমূহ