১৯ ডিসেম্বর, ২০০৮

নির্বাচনে যুদ্ধাপরাধী প্রার্থীরা -০৪

আবদুল খালেক মণ্ডল

নিজস্ব প্রতিবেদক, সাতক্ষীরা

এবারো সাবেক জামায়াত এমপি আবদুল খালেক মণ্ডল সাতক্ষীরা-২ আসন (সদর) থেকে চারদলীয় জোটের মনোনয়ন পেয়েছেন। একাত্তরে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় খুন, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ, লুটপাটসহ অগণিত অভিযোগ রয়েছে আবদুল খালেক মণ্ডলের বিরুদ্ধে। ১৯৭১ সালের ৭ ডিসেম্বর সাতক্ষীরা হানাদারমুক্ত হওয়ার দিন মুক্তিযোদ্ধারা তাকে আটক করে। সে সূত্রে আবদুল খালেক মণ্ডল ছিলেন সাতক্ষীরা কারাগারের প্রথম যুদ্ধাপরাধী বন্দি। সাতক্ষীরা সদর উপজেলার ঘোনা গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুর রশিদ একাত্তরের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে সাবেক জামায়াত এমপি আবদুল খালেক মণ্ডলের জীবনের কালো অধ্যায় সম্পর্কে জানান। স্বাধীনতা যুদ্ধের ৯ মাসে লুটপাট, অগ্নিসংযোগ, খান সেনাদের ক্যাম্পে নারী সাপ্লাই, প্রয়াত সাংবাদিক সুনীল ব্যানার্জির বাড়ি দখল, অসংখ্য নিরপরাধ মানুষকে হত্যাসহ বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে পৈশাচিকভাবে নরহত্যার মতো অপরাধ করেছেন আবদুল খালেক মণ্ডল। ভীতসস্ত্রস্ত মানুষ তার উপাধি দিয়েছিল ‘জল্লাদ খালেক’।

একাত্তরের আমলনামা :
সাতক্ষীরা সদর উপজেলার সীমান্তঘেঁষা খলিলনগর গ্রামের লালচাঁদ মণ্ডলের ছেলে আবদুল খালেক মণ্ডল মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পরপরই রাজাকার বাহিনীতে যোগ দেন। তিনি পাকসেনাদের বিশ্বস্ত সহচর হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। তারই নেতৃত্বে সীমান্তবর্তী কাথণ্ডা গ্রামের আবুল হোসেন গাজীকে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করা হয়। তার সহযোগিতায় এলাকার অসংখ্য নিরপরাধ এবং মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সদস্যকে পাকহানাদার বাহিনীর বৈকারী ক্যাম্পে ধরে নিয়ে নির্যাতন ও হত্যা করা হয়। তাদের মধ্যে আছেন খলিলনগর গ্রামের মুনছুর আলী সরদার, কাথণ্ডা গ্রামের হিমেপান্তি ও বলদঘাটা গ্রামের সামসুর রহমান প্রমুখ। একই এলাকার অহেদকে মুক্তিযোদ্ধা সন্দেহে খালেক মণ্ডল বাড়ি থেকে পাকসেনাদের ক্যাম্পে ডেকে নেয় এবং তারই পরামর্শে বর্বর খান সেনারা অহেদকে গুলি করে হত্যা করে। ঘোনার বাঁশিয়াপাড়ার তাহের আলীর ছেলে ভারতে মুক্তিযোদ্ধা ট্রেনিংয়ে যাওয়ার কারণে খালেক মণ্ডল ও এক পাকসেনা স্থানীয় দাঁতভাঙা বিল থেকে ধরে নিয়ে তাকে গুলি করে হত্যা করে। কাথণ্ডা গ্রামের শহর আলী দফাদার, মোহর আলী দফাদার, বদরুজ্জামান মল্লিক, আবদুর রাজ্জাক সরদার ও দেলোয়ার হোসেন সরদারসহ ৭ জন মুক্তিযোদ্ধাকে খালেক মণ্ডলের নেতৃত্বে বৈকারী ক্যাম্পে ধরে এনে উল্টো করে ঝুলিয়ে অমানসিক নির্যাতন করা হয়। ভাগ্যক্রমে তারা সবাই বেঁচে যান। একাত্তরের এপ্রিলে সাতক্ষীরা সরকারি বালক বিদ্যালয়ের পাশে সংঘটিত ভয়াবহ গণহত্যার নেতৃত্ব দিয়েছিলেন আবদুল খালেক মণ্ডল। এই হত্যাযজ্ঞে ভারতে আশ্রয় নেওয়ার উদ্দেশ্যে সেখানে জড়ো হওয়া শত শত নারী-পুরুষ-শিশুকে ঠাণ্ডা মাথায় হত্যা করা হয় বলে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের দাবি। শহরের ডায়মন্ড হোটেলের (তৎকালীন) টর্চার সেলে জল্লাদের ভূমিকা পালন করতেন তিনি। তারই নেতৃত্বে সীমান্তঘেঁষা বৈকারী, সাতানী, কাথণ্ডা ও ভাদড়ায় বহু বাঙ্কার খনন করা হয়। ওইসব বাঙ্কারে ভারতগামী অসংখ্য শরণার্থীকে হত্যা করে মাটিচাপা দেওয়া হয়। সমকাল প্রতিনিধিকে এসব কথার বয়ান দেন সাতক্ষীরা জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের আহ্বায়ক এনামুল হক এবং ঘোনা গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা আবদুর রশিদ।

স্বাধীনতা যুদ্ধকালে বৈকারী হাইস্কুলের দশম শ্রেণীর ছাত্র জালালউদ্দিন জানান, খালেক মণ্ডলের নির্দেশে বাঙ্কার খুঁড়তে অস্বীকৃতি জানানোয় খলিলনগর গ্রামের ঈমান আলীকে গুলি করে হত্যা করা হয়। জালাল বলেন, যুদ্ধের সময় একদিন বৈকারী স্কুলে এসে আলবদর কমান্ডার খালেক ১৭ জন ছাত্রের তালিকা করে তাদের বাঙ্কার খোঁড়ার নির্দেশ দেন। হুকুম না মানায় রাজাকার বাহিনী তার বাড়িতে হামলা-ভাংচুর চালায়। শহরের পলাশপোল এলাকার যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা এরশাদ হোসেন খান চৌধুরী বলেন, ‘সাতক্ষীরা-২ আসনের চারদলীয় জোটপ্রার্থী সাবেক জামায়াত এমপি আবদুল খালেক মণ্ডল একজন যুদ্ধাপরাধী।’

এদিকে আবদুল খালেক মণ্ডলের যুদ্ধাপরাধ বিষয়ক কর্মকাণ্ডের সাক্ষ্য দিতে গিয়ে সাতক্ষীরা সদর উপজেলার বাঁশদহ গ্রামের বাসিন্দা ঢাকা পিজি হাসপাতালের চিকিৎসক সহিদুর রহমান জানান, ১৯৭১ সালের ৭ ডিসেম্বর সাতক্ষীরা হানাদারমুক্ত হয়। সেদিন আমি সাইকেলে চড়ে শহরে আসার পথে কদমতলা ব্রিজের কাছে এসে দেখতে পাই খালেক মণ্ডলসহ তিনজনকে পিঠমোড়া করে বেঁধে রাখা হয়েছে।

এর পরের ঘটনা সম্পর্কে সাতক্ষীরা সদর উপজেলার ঘোনা গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুর রশিদ আরো বলেন, ‘সেদিন অলৌকিকভাবে জনরোষ থেকে প্রাণে বেঁচে যান আবদুল খালেক মণ্ডল। তবে সাতক্ষীরা কারাগারে প্রথম যুদ্ধাপরাধী বন্দি ছিলেন তিনি। কয়েক মাস সেখানে কারাভোগের পর বঙ্গবন্ধুর সাধারণ ক্ষমার সুযোগ তিনি মুক্তি পান। পরবর্তী সময়ে সাতক্ষীরা সদর উপজেলার একটি মাদ্রাসায় চাকরি নেন আবদুল খালেক মণ্ডল।’

একই ঘটনা পরম্পরা ব্যক্ত করতে গিয়ে প্রয়াত সাংবাদিক সুনীল ব্যানার্জির ভাই কল্যাণ ব্যানার্জি বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পরপরই খালেক মণ্ডল শহরের ফুড অফিস মোড়ে অবস্থিত আমাদের পৈতৃক বাড়িটি দখল করে নেন। এরপর টানা ৮ মাস ওই বাড়িতে খালেক মণ্ডল তার রাজাকার সঙ্গীদের নিয়ে বসবাস করেন। ৭ ডিসেম্বর সাতক্ষীরামুক্ত হওয়ার পর বাড়িটি থেকে পালিয়ে যাওয়ার সময় কদমতলা ব্রিজের কাছে তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে ধরা পড়েন।’

এদিকে আঁগরদাড়ি মাদ্রাসায় অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালনকালে খালেক মণ্ডলের বিরুদ্ধে ১ লাখ ৩৬ হাজার টাকা আত্মসাতের অভিযোগে ওঠে। পরে ওই টাকা তিনি সরকারি কোষাগারে ফেরত দিতে বাধ্য হন।

এমপি হওয়ার পরের ভূমিকা:
জোট সরকারের শাসনামলে সাতক্ষীরা-২ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর আবদুল খালেক মণ্ডলের বিরুদ্ধে জঙ্গি মদদের অভিযোগ ওঠে। ২০০৫ সালের ১৭ আগষ্ট দেশব্যাপী সিরিজ বোমা হামলার পর শুরু হয় পুলিশের জঙ্গিবিরোধী অভিযান। জেএমবি জঙ্গি গোষ্ঠীকে প্রথম শনাক্ত করা হয় সাতক্ষীরা থেকেই। কিন্তু সাবেক জামায়াত এমপি আবদুল খালেক মণ্ডলের অবৈধ হস্তক্ষেপে বাধাগ্রস্ত হতে থাকে পুলিশের জঙ্গিবিরোধী অভিযান। এর প্রমাণ হচ্ছে ওই সময় তার বিরুদ্ধে করা জিডিগুলো। সাতক্ষীরা সদর থানার তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) গোলাম মোহাম্মদ জঙ্গিবিরোধী অভিযানে প্রতিবন্ধকতার কারণে আবদুল খালেক মণ্ডলের বিরুদ্ধে ৭টি জিডি করেন। কিন্তু আবদুল খালেক মণ্ডল থেকে যান ধরাছোঁয়ার বাইরেই। জোট শাসনামলে সরকারের ত্রাণের টিন খালেক মণ্ডলের নির্দেশনা অনুযায়ী জামায়াতের অনুগত বিভিন্ন ধর্মীয় সংগঠনের নেতা-কর্মীদের মধ্যে বিতরণ করার অভিযোগ ওঠে।

২০০৬ সালের ১৯ মার্চ দৈনিক খবরের একটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ১৯৯৭ সালের ১৭ মে খালেকের বাড়িতে বসে জেএমবির প্রথম মজলিসে শূরা গঠন করা হয়। এরপর ১৯৯৮ সালে জেএমবির আত্মপ্রকাশ ঘটে। প্রথম মজলিসে শূরার বৈঠকে ২০১৫ সালের মধ্যে তালেবানি কায়দায় জিহাদের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখলের সিন্ধান্ত গৃহীত হয়।

আবদুল খালেক মণ্ডলের সাফাই:
বরাবরই আবদুল খালেক মণ্ডল তার বিরুদ্ধে আনীত এসব অভিযোগ অস্বীকার করে এসেছেন। তার দাবি, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে একটি মহল এসব অপপ্রচার চালায়, যার সঙ্গে বাস্তবতার কোনো মিল নেই। এদিকে স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে আবদুল খালেকের এমপি হওয়া এবং এবারো মনোনয়নপ্রাপ্তি প্রসঙ্গে যুদ্ধকালীন তার অসংখ্য অপকর্মের প্রত্যক্ষদর্শী স্থানীয় কয়েকজন বীর মুক্তিযোদ্ধা ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বলেন, ‘লাখো শহীদের আত্মত্যাগের ফসল উঠেছে যুদ্ধাপরাধীদের ঘরে। তা না হলে কি সে এমপি হতে পারে?’

দৈনিক সমকাল, ১৮ ডিসেম্বর, ২০০৮

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

জনপ্রিয় পোস্টসমূহ