আন্তর্জাতিক লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান
আন্তর্জাতিক লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান

৫ ডিসেম্বর, ২০০৮

বাংলাদেশ জেনোসাইড স্টাডি গ্রুপ

BGSG বাংলাদেশের গণহত্যা নিয়ে একটি তথ্যসমৃদ্ধ আর্কাইভ তৈরি করেছে। Kean University বাংলাদেশের গণহত্যা নিয়ে নিয়ে কোর্স চালায় তার জন্য এই আর্কাইভের প্রয়োজন। কিন্তু এর পাশাপাশি এরা ইহুদি গণহত্যা ও অন্য গণহত্যা নিয়েও কাজ করার প্রত্যাশা করে। নিউ জার্সির Holocaust Commission এর সাথে এই আর্কাইভ সম্পর্কিত।
নিজেদের সম্পর্কে বর্ণনা করতে গিয়ে বলেছে
The group has Bangladesh genocide as its primary agenda; however, the group will also honor the issue of human rights and genocide in other countries. The goal of this organization is to work with the relevant organizations that work for human rights and voice against crime against humanity. Thus, the study and the work of this group shall not be limited only on Bangladesh Genocide.

BGSG বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন ধরণের সেমিনার, সিরিজ বক্তৃতা, আলোচনা সভা, মুক্তিযুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্থদের সাথে কিংবা তাদের পরিবারের সাথে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা বিনিময়, গণহত্যার ছবি নিয়ে প্রদর্শনীর আয়োজন, ভিডিও প্রদর্শনীর আয়োজন ইত্যাদি পদ্ধতিতে আন্তর্জাতিক বাতাবরণে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য কাজ করে।

বিস্তারিত তথ্যের জন্য BGSG'র ওয়েবসাইট ভ্রমণ করুন।

২৪ আগস্ট, ২০০৮

ভারতীয় জুজুর কাল্পনিক ধুয়া

’৭৫ এর ট্র্যাজেডি ॥ মার্কিন দলিলে -৪
অজয় দাশগুপ্ত

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট নারকীয় হত্যাকাণ্ডে বাংলাদেশে রাজনৈতিক ক্ষমতার পরিবর্তনের পর থেকেই রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাক আহমদ এবং তার সহচররা বাংলাদেশে ভারতীয় হস্তক্ষেপের সম্ভাবনার কথা বলতে থাকে। বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার মধ্য দিয়ে ক্ষমতাসীন কর্তৃপক্ষ যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য দেশের প্রতি নতুন সরকারকে দ্রুত স্বীকৃতি প্রদানের অনুরোধ জানায় এ যুক্তিতে যে, এর ফলে ভারত বাংলাদেশে সামরিক অভিযান চালানো থেকে বিরত হবে। পাকিস্তান ১৫ আগস্টেই খন্দকার মোশতাক আহমদের সরকারকে স্বীকৃতি জানানোর পেছনেও একই অজুহাত দেখায়। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দফতর এবং ভারতে অবস্থিত তার দূতাবাসও বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে সৈন্য চলাচলের ওপর সতর্ক নজর রাখে।

প্রকৃত পরিস্থিতি কী ছিল সেটা কি তারা জানত না, এ প্রশ্ন উঠতেই পারে।
১৯৭৫ সালের ২৬ আগস্ট বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতীয় দূতাবাসের প্রথম সচিব রণেন সেন ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাসের কর্মকর্তাদের সঙ্গে দেখা করেন।

ঢাকাস্থ যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত ২৭ আগস্ট ওয়াশিংটনে পররাষ্ট্র দফতরে যে বার্তা পাঠিয়েছেন তাতে বলা হয় : রণেন সেন জানান, ‘বাংলাদেশে ভারতের একমাত্র স্বার্থ হচ্ছে স্থিতিশীলতা বজায় রাখা। এখানে কী ধরনের সরকার ক্ষমতায় কিংবা কী অর্থনৈতিক নীতি অনুসরণ করা হচ্ছে তা নিয়ে ভারতের মাথাব্যথা নেই। তবে যদি হিন্দুরা মনে করে যে তাদের ওপর হুমকি সৃষ্টি হয়েছে এবং ভারতে আশ্রয়লাভের চেষ্টা চালায়, সেটা ভারতের জন্য গভীর উদ্বেগের কারণ হবে।’
বোস্টার তার প্রতিবেদনে বলেন, ‘অভ্যুত্থান ঢাকাস্থ ভারতীয় হাইকমিশনকে সম্পূর্ণ বিঘ্নিত করে। অভ্যুত্থানের সকালে ভারতীয় হাইকমিশন অফিস এবং এর স্টাফদের বাসস্থানগুলোর সব টেলিফোন সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়। ঢাকায় ভারতীয় অভিমত হচ্ছে, অভ্যুত্থান যে নিঁখুতভাবে সংঘটিত হয়েছে তাতে স্পষ্ট যে কিছু বৈদেশিক শক্তির অবশ্যই সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। এ ঘটনায় কোন বিদেশি শক্তি জড়িত সে বিষয়ে রণেন সেন কারো নাম বলেননি।’

এ সাক্ষাৎকার প্রসঙ্গে বোস্টারের মন্তব্য : ঢাকায় ভারতীয়রা ভারতের প্রতি বাঙালিদের মনোভাবের গভীরতা উপলব্ধি করে এবং ভারতের অভিপ্রায় নিয়ে অব্যাহত জল্পনা-কল্পনা রয়েছে সেটাও তারা জানে। আমরা মনে করি, ‘বাঙালিরা যে ভীতির (ভারতের তরফে) মধ্যে রয়েছে বলে অব্যাহতভাবে আমাদের কাছে জানাচ্ছে সেটা দূর করার জন্যই রণেন সেন আমাদের কাছে এসব কথা বলেছেন। সম্ভবত তারা এটাও চেয়েছে যে, আমরা তা বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে দেই।’

বঙ্গবন্ধু সরকারের বিরুদ্ধে যে চক্রান্ত হচ্ছে সেটা নিশ্চিতভাবেই ভারত জানত। যেমন জানত যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃপক্ষ। ১৭ আগস্ট যুক্তরাষ্ট্র পররাষ্ট্র দফতর তাদের বিভিন্ন দূতাবাসের জন্য যে সারসংক্ষেপ প্রেরণ করে তাতে ‘বাংলাদেশে অভ্যুত্থানের বিষয়ে ভারতের প্রতিক্রিয়া’ অংশে বলা হয় : ১৬ আগস্ট নয়াদিল্লিতে ভারতের একজন কর্মকর্তা নয়াদিল্লিস্থ মার্কিন দূতাবাসকে জানায়, ভারত সরকার কয়েক মাস আগেই একদল হতাশ ও ক্ষুব্ধ রাজনীতিক এবং খন্দকার মোশতাক আহমদ ও মুজিব কর্তৃক সম্প্রতি পদচ্যুত একজন ক্যাপ্টেনের নেতৃত্বে সামরিক অফিসারদের অভ্যুত্থান পরিকল্কপ্পনা জানতে পেরেছিল। এ সময়ে ওই কর্মকর্তা আরো জানান, তারা নতুন সরকারের পররাষ্ট্রনীতি বিশেষ করে পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে খন্দকার মোশতাক আহমদের সুপরিচিত অবস্থানের বিষয় নিয়ে উদ্বিগ্ন। ভারতে যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাস সংবাদপত্র সূত্রে জেনেছে, ইন্দিরা গান্ধীর সরকার ঢাকায় অভ্যুত্থানের বিষয়ে সম্পাদকীয় মন্তব্য লেখায় সেন্সরশিপ আরোপ করেছে। (ভারতে ওই সময়ে জরুরি আইন বলবৎ ছিল)।

১৮ আগস্ট নয়াদিল্লিস্থ যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাস জানায় : ‘কলকাতায় বাংলাদেশ সীমান্তের কাছে বসবাসকারী সূত্রের উল্লেখ করে জানায়, সীমান্ত এলাকায় ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ) এবং সম্ভবত নিয়মিত সেনাবাহিনীর শক্তি বৃদ্ধি করা হয়েছে। এর উদ্দেশ্য সম্ভবত বাংলাদেশে অভ্যুত্থানের পর হিন্দু শরণার্থীদের আগমন বন্ধ করা। কলকাতায় অনেক গুজব শোনা যাচ্ছে। কিন্তু প্রাপ্ত তথ্য থেকে এ উপসংহারে পৌঁছানো যায় যে, সামরিক বাহিনীর চলাচল যে মাত্রাতেই ঘটে থাকুক না কেন তার উদ্দেশ্য পশ্চিমবাংলায় শরণার্থী প্রবেশ ঠেকানো এবং কোনোভাবেই বাংলাদেশে ভারতীয় সামরিক হস্তক্ষেপের প্রস্তুতি নয়।’

নয়াদিল্লিস্থ দূতাবাস আরো জানায় : ১৫ আগস্টেই পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী (সিদ্ধার্থ শংকর রায়) শরণার্থী অনুপ্রবেশ ঠেকাতে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। তিনি বাংলাদেশে হিন্দু-মুসলিম সংঘাত বিষয়ে কিছু প্রকাশ না করার জন্য অনুরোধ করেন।

যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাস ওয়াশিংটনকে আরো জানায় : বাংলাদেশে ভারতীয় সেনা হস্তক্ষেপের প্রস্তুতি বিষয়ে দিল্লিতে কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। কলকাতায় মার্কিন কনসাল জেনারেলের এক প্রশ্নের উত্তরে ভারতীয় সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডার জেনারেল জ্যাকব ১৬ আগস্ট জানান : ভারতীয় সেনাবাহিনী বিশেষ কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করছে না।

জেনারেল জ্যাকবের মন্তব্য : ১৬ আগস্ট জেনারেল জ্যাকব এক ডিনার পার্টিতে ভারতে মার্কিন দূতাবাসের এক কর্মকর্তার কাছে বাংলাদেশের ঘটনাবলির বিষয়ে জানতে চান। এ ব্যাপারে কলকাতাস্থ মার্কিন কনসাল জেনারেলের কাছে যে রিপোর্ট রয়েছে সেটা তাকে অবহিত করে বলি, এ পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্যে প্রতীয়মান হয়, অভ্যুত্থান তেমন বিরোধিতা ছাড়াই সংঘটিত হয়েছে এবং পরিস্থিতি এখন শান্ত। জ্যাকব বলেন, তিনি ঢাকায় নয়, আশপাশের জেলাগুলোতে উল্লেখযোগ্য লড়াইয়ের বিষয়ে শুনেছেন।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিবেদনে বলা হয় : জ্যাকব অভ্যুত্থানকে নিন্দনীয় বলে মনে করেন। তিনি বলেন, এখন বাংলাদেশে কোনো স্থিতিশীলতা থাকবে না। পাল্টা অভ্যুত্থান ও সংঘর্ষের আশঙ্কাও রয়েছে। তিনি বাংলাদেশকে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ঘোষণার বিষয়ে ঢাকার নতুন প্রশাসনের অভিপ্রায় বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন। তার কাছে ভারতে বাংলাদেশ থেকে কোনো হিন্দু শরণার্থী আগমনের বিষয়ে কোনো তথ্য আছে কি-না জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, এ বিষয়টি এখনই বলা যাচ্ছে না। ভারতীয় সেনাবাহিনী কোনো বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করছে কি-না জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, বিশেষ কিছু না।

কলকাতায় ভারতীয় কনসুলেট অফিসের এক কর্মকর্তা ১৬ আগস্ট ওয়াশিংটনে জানান : বাংলাদেশের অভ্যুত্থানের বিষয়ে যাদের সঙ্গে কথা হয়েছে তারা সবাই এ ঘটনার নিন্দা জানান। তবে তাদের কেউই মনে করেন না যে, ভারতের বাংলাদেশ দখল করে নেওয়া উচিত।

নেপালে যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাস থেকে ওয়াশিংটনে ২৫ আগস্ট যে বার্তা পাঠানো হয় তাতে বলা হয় : রাজা থেকে সাধারণ মানুষ পর্যন্ত সবাই জানতে চায় বাংলাদেশের ঘটনাবলিতে ভারত কতটা জড়িত হবে। ভারতের প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপ ঘটবে কি-না সেটাও তারা জানতে চায়। আমরা তাদের বলছি, সাম্প্রদায়িক হানাহানি না ঘটা এবং প্রতিদ্বন্দী সামরিক ইউনিটগুলোর মধ্যে সংঘাত না ঘটায় বর্তমান সময়ে ভারতের হস্তক্ষেপের সম্ভাবনা খুব কম। নেপালিরা বাংলাদেশে ক্ষমতা পরিবর্তনে যুক্তিসঙ্গতভাবেই সন্তুষ্ট। নেপাল সরকার চীন ও পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে মোশতাক সরকারের উদ্যোগকে স্বাগত জানায়। তবে নেপালিরা মুজিব এবং তার পরিবারের সদস্যদের নির্মমভাবে হত্যার নিন্দা করে।

ইন্দিরার কাছে মোশতাকের বার্তা : ২৬ আগস্ট নয়াদিল্লিস্থ ভারতীয় রাষ্ট্রদূত ওয়াশিংটনে জানান, ২৫ আগস্ট ভারতে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এবং বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাক আহমদের একটি বার্তা হস্তান্তর করেন। এতে বাংলাদেশের নেতা বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য দুই দেশের যৌথ সংগ্রামের কথা উল্লেখ করেন। তিনি ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে সম্পাদিত দ্বিপক্ষীয় চুক্তির প্রতি বাংলাদেশ সম্মান জানাবে বলে জানান।
রাষ্ট্রদূতের কাছে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপনে ভারতের আগ্রহের কথা ব্যক্ত করেন।
২৭ আগস্ট বাংলাদেশে নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত বোস্টার যুক্তরাষ্ট্রকে জানান : ভারত সরকার বাংলাদেশের বিরুদ্ধে বৈরী প্রচারণার জন্য ভারতীয় সুবিধা ব্যবহার করতে না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। জানা গেছে, ভারতের তথ্যমন্ত্রী শুক্লা ২৪ আগস্ট বিদেশি সাংবাদিকদের জানান, আমরা আমাদের সুবিধাদি আমাদের বাংলাদেশের বন্ধুদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করতে দিতে চাই না। তিনি বাংলাদেশের ঘটনাবলি ভারতে প্রচারের বিষয়ে কিছু বিধি-নিষেধ আরোপের বিষয়েও বিদেশি সাংবাদিকদের অবহিত করেন।

এরই ধারাবাহিকতায় ২৭ আগ¯দ্ব খন্দকার মোশতাক আহমদ সরকারের প্রতি আসে ভারত সরকারের কাঙ্ক্ষিত স্বীকৃতি। ২৮ আগস্ট নয়াদিল্লিস্থ ভারতীয় দূতাবাস ওয়াশিংটনকে জানায় : ২৭ আগস্ট বিদেশ মন্ত্রণালয়ের একজন মুখপাত্র ঢাকার নতুন শাসকদের প্রতি ভারতের স্বীকৃতি প্রদানের বিষয়ে অবহিত করেন।
এর মধ্য দিয়ে ১৫ আগস্টের অভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশে ভারতের ভূমিকা কী হবে সেটা নিয়ে জল্লনা-কল্পনার অবসান ঘটবে বলে ধারণা হতে পারত। কিন্তু পরবর্তী তিন দশকের বেশি সময়েও সেটা ঘটেনি। বাংলাদেশে ভারত সর্বদাই একটি ফ্যাক্টর রয়ে গেছে। বিশেষ করে অভ্যন্তরীণ রাজনীতির নানা সমীকরণে তাদের বারবার টেনে আনার জন্য একটি মহল বরাবরই সক্রিয়। এ ক্ষেত্রে ভারতকে কখনো কখনো এমন অবস্থানে রাখা হয়, যার সঙ্গে বাস্তবের মিল থাকে সামান্যই। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর বাংলাদেশে ভারত সামরিক হস্তক্ষেপ করতে চলেছে বলে যে জুজু দেখানো হয়, সেটা ছিল এ ধরনেরই।
---------
সমকাল ১৬ আগস্ট

১৪ আগস্ট, ২০০৮

অভ্যুত্থান চলাকালেই কিসিঞ্জার খবর পাচ্ছিলেন, বঙ্গবন্ধু তখনো বেঁচে

সমকাল (১৩ আগস্ট ২০০৮) পত্রিকায় বিভিন্ন গোপন দলিলে প্রাপ্ত তথ্য নিয়ে অজয় দাশগুপ্তের একটি মূল্যবান লেখা প্রকাশিত হয়েছে। এতে বঙ্গবন্ধু হত্যাকালীন সময়ে আমেরিকার পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরী কিসিঞ্জার ও তার স্টাফ অফিসারদের কথোপকথনের কিছু ব্যাখ্যা রয়েছে। আন্তর্জাতিক রাজনীতির অজানা কাহিনী সমৃদ্ধ এই লেখাটি সংগ্রহ করা হয়েছে সমকাল পত্রিকা থেকে।

অভ্যুত্থান চলাকালেই কিসিঞ্জার খবর পাচ্ছিলেন, বঙ্গবন্ধু তখনো বেঁচে
৭৫ এর ট্রাজেডি মার্কিন দলিলে

অজয় দাশগুপ্ত

[যে কোনো বৃহৎ শক্তির কূটনৈতিক কর্মকান্ডে বিস্তর লিখিত দলিল চালাচালি হয়। আর এতে থাকে আপাতভাবে তুচ্ছ থেকে শুরু করে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার আনুপূর্ব বিবরণ। তাৎক্ষণিক প্রয়োজন তো আছেই, আরেকটি উদ্দেশ্য ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য শিক্ষণীয় রেখে যাওয়া। বাংলাদেশের ১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্ট ট্র্যাজেডি যুক্তরাষ্ট্রের কাছে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল। বঙ্গবন্ধু হত্যা-কান্ডে তাদের সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ সুবিদিত। এর সত্যতা অনুসন্ধানে গবেষকরা নিরন্তর চেষ্টা চালা-চ্ছেন। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দফতরের শত শত দলিলে ওই সময়ের ঘটনাবলির রয়েছে লিখিত বিবরণ। ঘটনার ৩০ বছর পর অতি গোপনীয় ও গোপনীয় নথি প্রকাশের বিষয়ে আইন প্রণয়নের কারণে এসব দলিল এখন শুধু ওই দেশের নাগরিক নয়, বিশ্ববাসীও জানতে পারছে। তবে নথি প্রকাশ করার আগে তা পর্যালোচনা-পরীক্ষা করে দেখবেন অরিজিনেটিং এজেন্সির প্রধান। তিনি যদি কোনো বিষয় প্রকাশ না করার সিদ্ধান্ত দেন তবে তা অনির্দিষ্টকাল আলোর মুখ দেখবে না। ১৫ আগষ্ট ট্র্যাজেডির সঙ্গে প্রত্যক্ষ সংশ্লিষ্টতা ছিল তৎকালীন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জারের। এখনো তিনি বেঁচে আছেন। তাই গোপনীয় ও অতি গোপনীয় হিসেবে চিহ্নিত মার্কিন পররাষ্ট মন্ত্রণালয়ের দলিল প্রকাশের আগে তার মতামত নেওয়া হয়েছে এবং তিনি বেশকিছু দলিল সংশোধিত আকারে প্রকাশের সিদ্ধান্ত দিয়েছেন। আর এ কারণেই বাংলাদেশের ইতিহাসের বিয়োগান্ত ও সুদূরপ্রসারী তাৎপর্যপূর্ণ অধ্যায়ের কিছু অংশ আপাতত থেকে যাচ্ছে অন্ধকারে। কে জানে, হয়তোবা চিরকালের জন্যই।]

১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্ট। শুত্রক্রবার। ওয়াশিংটন সময় সকাল ৮টা। বাংলাদেশে তখন ১৫ আগষ্ট, রাত ১০টা। এদিন প্রত্যুষে বাংলাদেশের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সামরিক অভ্যুত্থানে নিহত হয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার তার স্টাফ সভায় বসেছেন কয়েকজন কর্মকর্তা নিয়ে। এখানে কী আলোচনা হয়েছে তার বিবরণ
পররাষ্ট্র দফতরের অনেক দলিলে, যার সংশোধন করা হয়েছে। অর্থাৎ পূর্ণ বিবরণ আপাতত জানার অবকাশ নেই।
বৈঠকের শুরুতেই কিসিঞ্জার বলেন, আমরা এখন বাংলাদেশ প্রসঙ্গে কথা বলব।
নিকট প্রাচ্য ও দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী আথারটন : এটা হচ্ছে সুপরিকল্কিপ্পত ও নিখুঁতভাবে বাস্তবায়ন করা অভ্যুত্থান।
কিসিঞ্জার : মুজিবুর কি জীবিত না মৃত?
আথারটন : মুজিব মৃত। তার অনেক ঘনিষ্ঠ সহচর, পরিবারের সদস্য, ভাই, ভাগ্নে নিহত হয়েছেন।
কিসিঞ্জার : আমি ব্যুরো অব ইন্টেলিজেন্স অ্যান্ড রিসার্চ (আইএনআর) থেকে ভালো পরামর্শ পেয়েছি [তিনি এ কর্মকর্তার সঙ্গে ওয়াশিংটনে আগেই কথা বলেছেন। তবে এটা ফোনে নাকি সরাসরি, সেটা স্পষ্ট নয়]।
হিল্যান্ড (ব্যুরো পরিচালক) : আমি যখন আপনার সঙ্গে কথা বলেছি তখন তিনি মৃত ছিলেন না।
কিসিঞ্জার : আচ্ছা? তারা কি কিছু সময় পর তাকে হত্যা করেছে?

এ আলোচনা থেকে স্পষ্ট, ১৫ আগষ্ট অভ্যুত্থান চলাকালেই কিসিঞ্জার অবহিত হচ্ছিলেন [১৫ আগষ্ট ঢাকার যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাস প্রেরিত বার্তায় বলা হয় : ঢাকার সময় বিকেল চারটা পর্যন্ত দেখা যায়, অভ্যুত্থান সফল হচ্ছে বলেই প্রতীয়মান হয়। কোনো সক্রিয় প্রতিরোধ দেখা যাচ্ছে না]।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের স্টাফ বৈঠকে কিসিঞ্জারের প্রথম প্রশ্নও সন্দেহ সৃষ্টি করে। তিনি প্রথমেই জানতে চেয়েছেন, মুজিব জীবিত নাকি মৃত। এ ধরনের ঘটনায় প্রথম প্রশ্ন হওয়ার কথা, মুজিব ক্ষমতায় আছেন কি নেই। কিন্তু প্রভাবশালী মার্কিন নেতা জানতে চেয়েছেন, বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি বেঁচে আছেন কি-না। ১০ ঘণ্টা আগে অভ্যুত্থান চলাকালেই তিনি ঘটনার বিবরণ পাচ্ছিলেন হিল্যান্ডের কাছ থেকে। এ অভ্যুত্থান রোধে তাদের কিছু করণীয় প্রতিকারের কথা ভাবেননি। বরং যেন মনে হয়, তিনি অপেক্ষা করে ছিলেন একটি দেশের রাষ্ট্রপতির মৃত্যু সংবাদের জন্য!

বাংলাদেশের স্থপতির প্রতি কিসিঞ্জারের বিরাগ ছিল ১৯৭১ সাল থেকেই। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওই বৈঠকে তিনি মুজিব সম্পর্কে যে মন্তব্য করেছিলেন তাতেও ওই বিদ্বেষের প্রতিফলন : হি ওয়াজ ওয়ান অব দ্য ওয়ার্ল্ড’স প্রাইজ ফুলস।
১৯৭৪ সালের ৩০ অক্টোবর কিসিঞ্জার এসেছিলেন বাংলাদেশে। তিনি বৈঠক করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে। এ সফরের মাত্র তিনদিন আগে ২৭ অক্টোবর অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ পদত্যাগ করেন। মুক্তিযুদ্ধকালে দেশের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালনকালে তিনি চমকপ্রদ দক্ষতা ও যোগ্যতার স্বাক্ষর রাখেন। তাকে অপসারণের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের চাপ ছিল বলে ধারণা করা হয়। কিসিঞ্জাসের সফরের প্রাক্কালে তাকে অপসারণ কাকতালীয় নাকি এর পেছনে কোনো বিশেষ কারণ ছিল, সেটা ইতিহাসের গবেষণার বিষয় হতে পারে। তাজউদ্দীনের অনমনীয় মনোভাবের কারণে একাত্তর সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্বপ্ন বিসর্জন দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও পাকিস্তানের পরিকল্পনা মেনে নেওয়ার জন্য খন্দকার মোশতাকের চক্রান্ত সফল হতে পারেনি।
১৯৭৪ সালের বন্যার পরপরই দেশে দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। এ সময়ে খাদ্যের ঘাটতি ছিল ব্যাপক এবং তা পহৃরণে যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে বাংলাদেশ সহায়তা চাইছিল।
কিসিঞ্জার বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে বৈঠকে বলেন, ‘আপনার তো দেখছি চারদিক থেকেই সমস্যা।’
বঙ্গবন্ধু বন্যা সমস্যা, খাদ্য সমস্যা, রাসায়নিক সারের ঘাটতি, জনসংখ্যা বৃদ্ধি, পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পদ বণ্টন এবং বাংলাদেশের বিভিন্ন শিবিরে অবস্থানকারী পাকিস্তানি নাগরিকদের তাদের দেশে ফিরিয়ে নেওয়ার প্রসঙ্গ তুললে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী সম্ভবত ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করেই ‘আপনার তো দেখছি চারদিক থেকেই সমস্যা’ বলেছিলেন। কারণ বৈঠকে তোলা প্রতিটি বিষয়েই তার অবস্থান ছিল বাংলাদেশের বিপক্ষে।
কিসিঞ্জারের বাংলাদেশ সফরের কিছুদিন আগে বঙ্গবন্ধু জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে ভাষণ দিয়েছিলেন। ওই সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জেরাল্ড ফোর্ডের সঙ্গে তার বৈঠক হয়। কিসিঞ্জারের সঙ্গে ঢাকায় আলোচনাকালে বঙ্গবন্ধু ফোর্ডকে বাংলাদেশ সফরের আমন্ত্রণ জানিয়ে বলেন, তিনি ভারতে তার আসন্ন সফরের সঙ্গে মিল রেখে ঢাকা আসতে পারেন। এর জবাবে কিসিঞ্জারের মন্তব্য ছিল কূটনৈতিক শিষ্টাচারের পরিপন্থী। তিনি ঢাকায় বঙ্গবন্ধুকে বলেন, ‘ফোর্ড ভারত সফরের সময়ে বাংলাদেশে আসতে পারেন। তবে আমরা মনে করি না বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের তরফে ভারতের অনুমতি গ্রহণের প্রয়োজন রয়েছে।’
কিসিঞ্জার ওয়াশিংটনে ফোর্ডের সঙ্গেও বঙ্গবন্ধুর বৈঠকের প্রসঙ্গ তোলেন। তিনি বলেন, প্রেসিডেন্ট আপনার সঙ্গে আলোচনায় সন্তুষ্ট। ণড়ঁ নধসনড়ড়ুষবফ যরস! এ বাক্যের অর্থ হতে পারে, আপনি তাকে মুগ্ধ করেছেন। আবার, আপনি তাকে কথার জাদুমালা আর ব্যক্তিত্ব দিয়ে ভুলিয়েছেন বলেও ধরে নেওয়া যায়। কিন্তু ধুরন্ধর কূটনীতিক যদি নধসনড়ড়ুষবফ শব্দের আক্ষরিক অর্থ ‘প্রতারণা’ বুঝিয়ে থাকেন?
ঢাকার বৈঠকে বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কাছে বাংলাদেশের ন্যায্য পাওয়ার প্রসঙ্গ তোলেন। তিনি বলেন, আমরা সম্পর্ক স্থাপনের জন্য অনেক কিছু করেছি। যুদ্ধবন্দিদের ছেড়ে দিয়েছি। পাকিস্তানের বৈদেশিক সম্পদের দায়দেনার যতটা আমাদের ওপর বর্তায় তা বহনের কথা জানিয়েছি। কিন্তু পাকিস্তান কেবল কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনে আগ্রহী।
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দফতর যে গোপনীয় দলিল সংশোধন করে প্রকাশ করেছে তাতে দেখা যায়, কিসিঞ্জার এ প্রশ্নে পাকিস্তানের বক্তব্যই তুলে ধরেছেন। তিনি বলেন, আমি পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আজিজ আহমদের সঙ্গে কথা বলেছি। তিনি দায়দায়িত্ব গ্রহণের বিষয়ে আপনাদের অনাগ্রহের কথা জানিয়েছেন।
প্রধানমন্ত্রী মুজিব : আমি ইতিমধ্যেই দায়দায়িত্ব গ্রহণ করেছি। আমরা এ বিষয়ে ঋণদাতাদের সঙ্গে চুক্তি করেছি। কিন্তু কেন আমি সম্পদের ভাগ পাব না?
মুজিব : আমরা এক বা দুই বছর খাদ্য সহায়তা চাই। আমি দেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করার জন্য ব্যাপক সহায়তা চাই। আমরা শিল্পের কাঁচামাল চাই। আমাদের পাটের জন্য ভালো দাম চাই।
এর জবাবেই কিসিঞ্জার বলেন, আপনার তো দেখি চারদিক থেকেই সমস্যা।
বঙ্গবন্ধু চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক স্থাপনে আগ্রহের কথাও বলেন। এ প্রসঙ্গে কিসিঞ্জারের বক্তব্য : তারা হয়তো আপনাদের সঙ্গে পাকিস্থানের সম্পর্ক স্থাপন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে চাইবে।

হ্যাঁ, পাকিস্তান বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছিল ১৫ আগষ্ট বঙ্গবন্ধুকে নৃশংসভাবে হত্যার পর। চীনও সম্পর্ক স্থাপন করে এ বিয়োগান্ত ঘটনার পর।
কিসিঞ্জার কি ১৫ আগষ্টের ঘটনা আগেই জানতেন?
বঙ্গবন্ধু বন্যায় খাদ্যশস্য বিনষ্ট হওয়া এবং বিশ্ববাজারে খাদ্যের দাম অনেক বেড়ে যাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে সাহায্য চাইলে কিসিঞ্জার বলেন, ‘আমাদের সমস্যা হচ্ছে, আমাদের কাছে উদ্বৃত্ত খাদ্য নেই। ... সাহায্য প্রসঙ্গে আমাদের কংগ্রেসের সঙ্গেও সমস্যা রয়েছে। আগামী মঙ্গলবার আমাদের কংগ্রেসের (প্রতিনিধি পরিষদ ও সিনেট) নির্বাচন। তবে ১৯৭০ সালে আপনি যেভাবে জিতেছিলেন তেমন সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রশাসন আশা করে না।
জবাবে বঙ্গবন্ধু রসিকতা করে বলেন, ‘নির্বাচনে অত বেশি আসন পাবেন না। আপনারা জানেন, আমি বিপুলভাবে জয়ী হওয়ার পর কী ঘটেছিল : পাকিস্তানিরা এখানে সবকিছু ধ্বংস করে দেয়। আমাকে গ্রেফতার করে। আমার পাঁচ বছরের ছেলেও বলে, আর নির্বাচনে দাঁড়াবে না।’
এর জবাবে কিসিঞ্জার বলেন, ‘আপনি নিশ্চয়ই কিছু সময়ের জন্য আপনার দেশে নির্বাচন এড়াতে চাইবেন না!’
বঙ্গবন্ধু যে কোনো সময়েই নির্বাচন এড়াতে চাননি সেটা কিসিঞ্জার সম্ভবত জানতেন না।
১৫ আগষ্ট ওয়াশিংটনের সকালের বৈঠকে ফিরে তাকানো যাক।
বৈঠকে আথারটন জানান, অভ্যুত্থানকারীরা মুজিবকে হত্যার জন্যই এসেছিল। তারা বাড়িটি ঘেরাও করে এবং ভেতরে গিয়ে তাকে মেরে ফেলে।
আগেও তাকে হত্যার চক্রান্ত প্রসঙ্গ তুলে কিসিঞ্জার বলেন : তাকে কি গত বছর আমরা এ বিষয়ে কিছু বলিনি?
আথারটন : গত মার্চে এ বিষয়ে আমরা অনেক ইঙ্গিত পাচ্ছিলাম।
কিসিঞ্জার : তাকে কি আমরা কিছু জানাইনি?
আথারটন : তাকে সে সময়ে জানিয়েছি।
কিসিঞ্জার : কারা এর পেছনে, সে বিষয়ে কি মোটামুটি কিছু ধারণা দিয়েছি?
আথারটন : কারা জড়িত সেসব নাম তাকে বলেছি কি-না, সেটা পরীক্ষা করে দেখতে হবে।
হিল্যান্ড : আমরা এ বিষয়ে ঠিক যথাযথ ধারণা দিইনি।
আথারটন : তিনি বিশ্বাস করেননি। তিনি বলেছেন, কেউ তাকে এ ধরনের কিছু করবে না।
বাংলাদেশের অভ্যুত্থান ‘সফল’ হওয়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দফতরের কাছে খবর পৌঁছে যায় : ‘যারা অভ্যুত্থান করেছে তাদের মধ্যে রয়েছে সামরিক অফিসার, মধ্য পর্যায় ও সিনিয়র অফিসার- যাদের সাধারণভাবে পূর্ববর্তী শাসকদের তুলনায় কম ভারতপন্থি, সোভিয়েতবিরোধী এবং মার্কিনপন্থি হিসেবে গণ্য করা যায়।
কিসিঞ্জার : এটাই হতে হবে।
আথারটন : তারা দেশের নাম পরিবর্তন করে ইসলামী প্রজাতন্ত্র রেখেছে।
কিসিঞ্জার : তারা যুক্তরাষ্ট্রপন্থি হবে, এটা অপরিহার্য নয়। প্রকৃতপক্ষে পথপরিক্রমায় তারা চীনাপন্থি এবং ভারতবিরোধী হবে বলে আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি। আমি সবসময়ই জানতাম, ভারত বাংলাদেশকে স্বাধীন করার জন্য একদিন অনুতাপ করবে। এ ভবিষ্যদ্বাণী আমি একাত্তর সালেই করেছি।
আথারটন : আমাদের বড় সমস্যা হবে বাংলাদেশের নতুন শাসকদের সঙ্গে খুব ঘনিষ্ঠতা বা মাখামাখি পরিহার করা।
কিসিঞ্জার : কেন তারা আমাদের প্রতি বন্ধুভাবাপন্ন বলে?
ঝানু কূটনীতিক কিসিঞ্জার ঠিকই বুঝেছিলেন স্বাধীন দেশের স্থপতিকে সপরিবারে হত্যার মধ্য দিয়ে যারা রাষ্ট্রক্ষমতায় এসেছে তারা তাদের বন্ধু এবং বৈঠকেই তিনি জানিয়ে দেন : ‘তারা আমাদের কাছ থেকে বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ পাবে। আমরা তাদের স্বীকৃতি দেব।’
১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্ট বাংলাদেশ তার ইতিহাসের কঠিনতম পথে যাত্রা শুরু করে। এর পেছনে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা ছিল ৩০ লাখ শহীদের রক্তে অর্জিত বাংলাদেশের জনগণের জন্য অগ্রহণযোগ্য এবং অবশ্যই ক্ষতিকর। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দফতরের যেসব গোপনীয় দলিল প্রকাশ করা হচ্ছে, তা থেকেও এ সাক্ষ্য মেলে।

জনপ্রিয় পোস্টসমূহ