ইতিহাস লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান
ইতিহাস লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান

২৮ মার্চ, ২০১২

মুক্তিযুদ্ধে অবদান রাখা ৫৬৮ জন বিদেশী বন্ধুকে সম্মাননা দেয়া হচ্ছে

Honor crest image for foreign freind of Bangladesh 1971
বিদেশী বন্ধুদের জন্য সম্মানা ক্রেস্ট
মুক্তিযুদ্ধে অনন্য অবদান রাখার জন্য বিদেশী বন্ধুদের সম্মাননা দেওয়া হবে। মানুষের চেতনায় লেখা হয়ে যাবে স্বাধীনতার চার দশক পরে কৃতজ্ঞতা জানানোর নতুন ইতিহাস। বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ২৬/০৩/২০১২ তারিখে মোট ৫৬৮ জন বিদেশী বন্ধুর তালিকা প্রকাশ করেছে। এ বন্ধুরা সম্মাননার জন্য মনোনীত হয়েছেন। এই তালিকায় ২৫৭ জন ভারতের, রাশিয়ার ৯ জন, যুক্তরাষ্ট্রের ৮৮ জন, পাকিস্তানের ৪১ জন, যুক্তরাজ্যের ৩৯ জন, আয়ারল্যান্ডের তিনজন, বেলজিয়ামের একজন, অস্ট্রেলিয়ার ছয়জন, কানাডার দুজন, কিউবার একজন, ফ্রান্সের ১৬ জন, ভুটানের পাঁচজন, দক্ষিণ কোরিয়ার একজন, মালয়েশিয়ার একজন, জাপানের ১৮ জন, শ্রীলঙ্কার দুজন, নেপালের ১৮ জন, সাবেক যুগোশ্লাভিয়ার দুজন, ভেনিজুয়েলার একজন, নেদারল্যান্ডসের পাঁচজন, নিউজিল্যান্ডের একজন, সুইডেনের দুজন, ডেনমার্কের একজন, আর্জেন্টিনার তিনজন, সুইজারল্যান্ডের আটজন, জার্মানির তিনজন, ইতালির দুজন, হল্যান্ডের একজন এবং ৩১টি সংস্থার নাম রয়েছে।

১৪ মার্চ, ২০১০

১৪ মার্চ, ২০১০

১৪ মার্চ, ১৯৭১। ঢাকার উত্তাল রাজপথে সেদিন ছিল এক ব্যতিক্রর্মী চিত্র। মাঝিমাল্লারা সব বৈঠা হাতে এদিন রাজপথে নেমে আসে। সেদিনের রাজপথ ছিল মাঝিমাল্লাদের দখলে। সামরিক আইনের ১১৫ ধারা জারির প্রতিবাদে সেদিন বেসরকারী কর্মচারীরাও বিক্ষোভে ফেটে পড়ে।

দেশের জনগণকে গণতান্ত্রিক অবস্থা থেকে বঞ্চিত করার প্রতিবাদে খ্যাতিমান শিল্পী শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন তাঁর 'হেলাল ইমতিয়াজ' খেতাব বর্জন করার ঘোষণা দেন।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এদিন নিয়মিত প্রেস ব্রিফিংয়ে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় বসার ব্যাপারে শর্তারোপ করেন। তিনি অবশ্য প্রেস ব্রিফিংয়ে বলেন, যদি প্রেসিডেন্টের দাবি পূরণের ইচ্ছা নিয়ে আলোচনায় বসতে চান, তা হলে আমি বসতে পারি। তবে বঙ্গবন্ধু দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে বসার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, কোনভাবেই তৃতীয় কোন পর্ব সেখানে উপস্থিত থাকতে পারবে না।

অন্যপক্ষে পাকিস্তান পিপলস পার্টির নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টো বঙ্গবন্ধুর দেয়া ৬ দফা দাবি প্রত্যাখ্যান করেন। তবে ঢাকায় এসে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে অলোচনার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। ন্যাপ (ওয়ালী) নেতা খান আবদুল ওয়ালী খান পূর্ব পাকিস্তান সফরকালে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে একান্তে আলাপ-আলোচনা করেন। পরে তিনি সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলার সময় বাঙালীর আন্দোলন এবং তাদের দাবির প্রতি পূর্ণ সমর্থন প্রকাশ করেন।

একাত্তরের রক্তঝরা এই দিনে জাতীয় লীগ নেতা আতাউর রহমান অস্থায়ী সরকার গঠনের জন্য বঙ্গবন্ধুর কাছে দাবি জানান। এ সময় দেশের পত্রিকাগুলোতেও আন্দোলনকে সমর্থন করে সম্পাদকীয় লেখা চলতে থাকে। আওয়ামী লীগের সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমেদ অসহযোগ আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ১৫ মার্চ পালনে ৩৫টি নতুন নির্দেশনা দেন। এ সময় সমগ্র বাংলাদেশ (পূর্ব পাকিস্তান) আওয়ামী লীগ এবং বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে চলতে থাকে।

এই দিনে ঢাকার বায়তুল মোকাররম মসজিদের সামনে ছাত্র ইউনিয়নের এক সমাবেশ থেকে দেশের ৭ কোটি জনতাকে সৈনিক হিসেবে সংগ্রামে অংশগ্রহণের আহ্বান জানানো হয়। তৎকালীন ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি নুরুল ইসলাম নাহিদের (বর্তমান শিক্ষামন্ত্রী) সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম (বর্তমানে সিপিবির সাধারণ সম্পাদক)। একই দিনে শিল্প সংগঠনগুলোর প্রতিনিধিরা শিল্প সংগ্রাম গঠন করেন।

বাঙালীর স্বাধীনতার আন্দোলনের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করে ঢাকার কবি-সাহিত্যিকরা 'লেখক সংগ্রাম শিবির' নামে একটি কমিটি গঠন করেছেন। আহ্বায়ক : হাসান হাফিজুর রহমান। সদস্য : সিকান্দার আবু জাফর, আহমদ শরীফ, শওকত ওসমান, শামসুর রাহমান, বদরুদ্দীন ওমর, রণেশ দাসগুপ্ত, সাইয়িদ আতীকুল্লাহ, বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর, রোকনুজ্জামান খান, আবদুর গাফ্ফার চৌধুরী, সুফিয়া কামাল, জহির রায়হান, আবদুল গনি হাজারীসহ অনেকে।

১৩ মার্চ, ২০১০

১৩ মার্চ, ২০১০

১৩ মার্চ, ১৯৭১। অনিবার্য হয়ে ওঠে বাংলাদেশের স্বাধীনতা। লাখো মুক্তিকামী বাঙালীর উত্তাল আন্দোলন-সংগ্রাম ও সশস্ত্র প্রস্তুতিতে শঙ্কিত হয়ে পড়ে পাকিসত্মানী সামরিক জান্তা। বিরোধী দলের নেতারা পাকিস্তানের অনিবার্য ভাঙ্গন নিশ্চিত বুঝতে পেরে একাত্তরের এদিন জরুরী বৈঠকে মিলিত হন। বৈঠক শেষে অবিলম্বে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের আহ্বান জানান। কিন্তু সেদিকে তোয়াক্কা না করে হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে স্বাধীনতার সংগ্রাম দমনে নিষ্ঠুর পরিকল্পনা নিতে থাকে হানাদাররা।

একাত্তরের মার্চ মাসে যত দিন গড়াচ্ছিল, স্বাধীনতাকামী বাঙালীর ঐক্য ততই সুদৃঢ় হচ্ছিল। বঙ্গবন্ধুর উদাত্ত আহ্বানে তখনকার চলমান অসহযোগ আন্দোলনের সঙ্গে নিবিড়, প্রত্যয়দৃঢ় একাত্মতা ঘোষণা করছিল বিভিন্ন সংস্থা সংগঠন।

অসহযোগ আন্দোলনের এক সপ্তাহ পর দেশ পুরোপুরি অচল হয়ে পড়ে। দেশের বিভিন্ন স্থানে কৃষক, শ্রমিক, চাকরিজীবী, সাংবাদিক, সাহিত্যিক, লেখক, শিক্ষক সব শ্রেণী-পেশার মানুষ নিজেদের অস্থিত্ব রক্ষার আন্দোলনে ডঝাঁপিয়ে পড়ে। পাকিস্তানী সামরিক শাসকরা বাংলার দাযমাল ছেলেদের এই আন্দোলন দেখে চিন্তিত হয়ে পড়ে।

পাক স্বৈরাচাররা পূর্ব পাকিস্তানের বাস্তব অবস্থা উপলব্ধি করতে পারে। তারা চারদিকে সতর্কদৃষ্টি রাখতে থাকে। পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি নিয়ে পাকিস্তানের বাঘা বাঘা নেতাও শঙ্কিত হয়ে পড়েন। একই দিনে জমিয়াতুল ওলেমা ইসলামিয়া সংসদীয় দলের নেতা মাওলানা মুফতি মাহমুদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এক সভা থেকে তিনটি আহ্বান জানানো হয়।

আহ্বানগুলো হলো_ পূর্ব পাকিস্তান থেকে সামরিক আইন প্রত্যাহার, ২৫ মার্চের আগে ক্ষমতা হস্তান্তর এবং সেনাবাহিনীকে ব্যারাকে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া। একই সঙ্গে প্রতিটি গ্রাম, শহর, বন্দর, নগরে চলতে থাকে তীব্র অসহযোগ আন্দোলন।

স্বাধীনতা- এই একক একটিমাত্র কেন্দ্রীয় লক্ষ্য সামনে রেখে জাতি চূড়ান্ত পর্বের জন্য তখন প্রস্তুতি নিচ্ছিল। একাত্তরের উত্তাল সেই সময়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো ছিল অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ। স্বাধীনতার সপক্ষে দৃঢ় সমর্থন ব্যক্ত করেন তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের সিভিল সার্ভিস এ্যাসোসিয়েশনের সদস্যবৃন্দ। আন্দোলন পরিচালনার মহৎ কাজে তাঁরা নিজেদের একদিনের বেতন দেয়ার সিদ্ধান্ত নেন। পূর্ব পাকিস্তান সাংবাদিক ইউনিয়ন স্বাধীনতা সংগ্রামের সঙ্গে একাত্ম হয়ে রাজপথে মিছিল করে।

মহান স্বাধীনতার জন্য উৎসুক, উন্মুখ বাঙালী জাতির ভাবনা তখন ছিল একটাই পাকিস্তানী স্বৈরশাসনের অচলায়তন কিভাবে ভাঙ্গা যাবে। আগুন ঝরানো মার্চ মাসে জাতির এই প্রবল উৎকণ্ঠা-উদ্বেগ এবং মাতৃভূমিকে মুক্ত করার অদম্য আকাঙ্ক্ষা পরবর্তীকালে সর্বাত্মক জনযুদ্ধে রূপ নেয়। চরম ত্যাগ-তিতিক্ষা রক্তের সিঁড়ি বেয়ে বাঙালী শেষ পর্যন্ত ছিনিয়ে আনে মহার্ঘ স্বাধীনতা।

১২ মার্চ, ২০১০

১২ মার্চ, ২০১০

১৯৭১ সালের এই দিনে প্রতিবাদ প্রতিরোধ বিদ্রোহ বিক্ষোভে সুপ্ত আগ্নেয়গিরি ঘুম ভেঙ্গে জেগে উঠেছিল। শেকল ছেঁড়ার অদম্য আকাঙ্ক্ষায় দুরন্ত দুর্বার হয়ে উঠছিল বীর বাঙালী জাতি। একাত্তরের এদিন চির পরিচিত শাপলাকে আমাদের জাতীয় ফুল করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। শিল্পী কামরুল হাসানের আহ্বানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবনে আয়োজিত শিল্পীদের এক সভাতে এ ঘোষণা দেয়া হয়। ঘোষণা শেষে মুক্তিকামী মানুষকে সেদিন আরও বেশি উৎসাহী করে তুলতে তাঁরা প্রতিবাদী পোস্টার, ব্যানার ও ফেস্টুন বিলি করেন।

একাত্তরের ১১ মার্চ জাতিসংঘের তদানীন্তন মহাসচিব উ থান্ট এক নির্দেশে বলেন, পূর্ব পাকিস্তানে কর্মরত জাতিসংঘের সকল কর্মকর্তা-কর্মচারী যেন সদর দফতরে ফিরে যান। এ নির্দেশে তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ক্ষুব্ধ বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, বাংলাদেশের মানুষও এ পৃথিবীর বাসিন্দা। তাদের প্রতিও জাতিসংঘের দায়িত্ব রয়েছে।

অন্যদিকে ক্রমেই স্তিমিত হতে থাকে পাকিস্তানী বাহিনীর কর্মকাণ্ড। লাগাতার অসহযোগ আন্দোলনের ফলেই পূর্ব বাংলায় থাকা পাকিস্তানী সামরিক জান্তারা দমে যেতে থাকে। মার্চের শুরুতে পতাকা উত্তোলন এবং ইশতেহার পাঠের পর থেকে বাঙালীর স্বাধীনতাপ্রাপ্তির আকাঙ্ক্ষা আরও তীব্র হতে থাকে। পেশাজীবীরা পথে নেমে আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে।

এই দিনে পূর্ব পাকিস্তানের সিভিল সার্ভিস এ্যাসোসিয়েশন বাঙালীর স্বাধীনতা আন্দোলনের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে। তারা আন্দোলনে অর্থের জোগান দিতে তাদের একদিনের বেতন দেয়ার ঘোষণা দেন। এ দিনে রাস্তায় নেমে আসেন শিল্পী, সাংবাদিক, সাহিত্যিক, কর্মজীবী সবাই। শ্লোগানে শ্লোগানে মাতিয়ে রাখে ঢাকার রাজপথ। পূর্ব পাকিস্তানের সাংবাদিক ইউনিয়ন আন্দোলনকে জোরদার করতে, আরও সংঘবদ্ধ করতে রাজপথে নেমে আসে। পাকিস্তানবিরোধী শ্লোগানে রাজপথকে উত্তাল করে তোলে জনতা। শিল্পী মুর্তজা বশীর ও কাইয়ুম চৌধুরীর নেতৃত্বে এ দিন চারুশিল্প সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। স্বাধীনতা সংগ্রামে এ পরিষদ বিশেষ ভূমিকা রাখে।

একাত্তরের মার্চ মাসের দিনগুলো ছিল থমথমে, উৎকণ্ঠা আশঙ্কায় পরিপূর্ণ। চাপা উদ্বেগে অস্থিরতা অনিশ্চয়তার আবর্তে ঘুরপাক খাচ্ছিল সাড়ে সাত কোটি বাঙালী। কি ঘটবে, কী ঘটতে যাচ্ছে_ তা নিয়ে চিন্তিত উৎকণ্ঠিত ছিলেন সকলেই। অবরুদ্ধ গণমানুষ ভিতরে ভিতরে প্রস্তুত হচ্ছিলেন চূড়ান্ত লড়াইয়ের জন্য। লৰ্য একটাই- নিরঙ্কুশ স্বাধীনতা। কারণ ততদিনে দিনের আলোর মতো স্পষ্ট হয়ে উঠছিল যে, পশ্চিম পাকিসত্মানী বেনিয়া দুর্বৃত্ত শোষকগোষ্ঠী বাঙালীকে তার ন্যায্য অধিকার কোন দিনই দেবে না।

১১ মার্চ, ২০১০

১১ মার্চ, ২০১০

"বন্ধু তোমার ছাড়ো উদ্বেগ, সুতীব্র করো চিত্ত/বাংলার মাটি দুর্জয় ঘাঁটি বুঝে নিক দুর্বৃত্ত।" ১১ মার্চ, ১৯৭১।

অগ্নিবিদ্রোহে টালমাটাল পুরো দেশ। কবির এই উজ্জীবনী মন্ত্রে দীপ্ত জাতি প্রতিবাদে, প্রতিরোধে তখন মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। স্বাধীনতার আন্দোলন ক্রমেই উত্তাল থেকে উত্তালতর হতে থাকে। শান্তিপূর্ণভাবে অসহযোগ আন্দোলন সফল হওয়ায় বঙ্গবন্ধুর ওপর দেশবাসীর আস্থা বেড়ে যায় অনেক।

পাকিস্তানী ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণ, নিপীড়ন-বঞ্চনার বিরুদ্ধে অগ্নিবিদ্রোহের চূড়ান্ত রণপ্রস্তুতি চলছিল একাত্তরের এই সময়টায়। বাঙালী জাতির মুখ্য চিন্তা ও লক্ষ তখন একটাই ছিল_ 'স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ।' তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান অনেক আগেই পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়।

একমাত্র সেনা ছাউনি ছাড়া টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া কোথাও পাকিদের নিয়ন্ত্রণে ছিল না। পুরো দেশ, মানুষ চলছিল একমাত্র এক ব্যক্তির নির্দেশে, তিনি হলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী ও সামরিক জান্তার রক্তচক্ষু ও আদেশ উপেক্ষা করেই সব দোকানপাট, অফিস-আদালত, কলকারখানা, কোর্ট-কাচারি বন্ধ রাখা হয়।

দেশজুড়ে চলতে থাকে মিটিং-মিছিল। সংঘবদ্ধ হওয়ার প্রচেষ্টা আরও জোরালো হয়। বিভিন্ন পাড়া-মহল্লায় দল গঠনের কাজ চলতে থাকে। শহরগুলোতে প্রতিদিনই মিছিল-মিটিং চলতে থাকে। পাক বাহিনীর গুলিতে শহীদ হন অনেকে। বাড়তে থাকে শহীদদের তালিকা। একেকটি মৃত্যু বীর বাঙালীর রক্তে প্রতিশোধের ইচ্ছাকে আরও বাড়িয়ে তোলে। চারদিকে উত্তেজনা বাড়তে থাকে। দেশের স্বাধীনতা আনতে অকাতরে জীবন বিলিয়ে দিতে সবাই প্রন্তুত।

এই দিনে ছাত্র ইউনিয়ন দেশবাসীকে সংগঠিত করতে একটি লিফলেট ছাড়ে। সেখানে তারা পাক হানাদারদের হাত থেকে দেশকে রক্ষা করতে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানায়। এভাবে একেকটি দিন যেতে থাকে আর বাড়তে থাকে উত্তেজনা। সংঘবদ্ধ হতে থাকে বাঙালী। বাড়তে থাকে বাঙালীর মনের জোর।

অনিবার্য স্বাধীনতার দিকে দেশ যাচ্ছে। পূর্ব পাকিস্তান হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে। এটা বুঝতে পেরে পাক সামরিক জান্তা গোপনে বাঙালী নিধনে ঘৃণ্য খেলায় মেতে ওঠে। যে কোন মূল্যে স্বাধীনতা ঠেকাতে পাকি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া বাঙালীর রক্তের হোলি খেলার ষড়যন্ত্র করতে থাকে। গোপনে পূর্ব বাংলায় পাকিস্তানী সামরিক শক্তি ও অস্ত্র-গোলাবারুদ মজুদ করতে থাকে। কিন্তু এই ঘৃণ্য পরিকল্পনার কথা সামরিক বাঙালী অফিসাররা জানতে পেরে তাঁরাও ভেতরে ভেতরে স্বাধীনতার জন্য লড়াইয়ে শক্তি-সাহস সঞ্চয় করতে থাকেন।

১০ মার্চ, ২০১০

১০ মার্চ, ২০১০

আজ ১০ মার্চ। ১৯৭১ সালের আরও একটি উত্তাল দিন। অগ্নিগর্ভ বিক্ষুব্ধ বাংলায় বিদ্রোহ-বিক্ষোভের তরঙ্গ প্রবহমান ছিল টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া পর্যন্ত। দেশজুড়ে বঙ্গবন্ধুর ডাকা অসহযোগ আন্দোলন চলছে। কোর্ট- কাচারি, অফিস-আদালত ছিল বন্ধ। সারাদেশে অসহযোগ আন্দোলনের পাশাপাশি চলছে চূড়ান্ত লড়াইয়ের প্রস্তুতি।

বাংলাদেশের অসহযোগ আন্দোলনের প্রভাব পড়ে পশ্চিম পাকিস্তানেও। আন্দোলনের তীব্রতা বুঝতে পেরে পশ্চিম পাকিস্তানের পত্রিকাগুলো তাদের সুর পাল্টে ফেলে। তারা বাংলাদেশের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের বিষয়ে পাকিস্তানের সামরিক সরকারকে চাপ দিয়ে নিবন্ধ প্রকাশ করে। ইংরেজী দৈনিক 'দি পিপলস' পত্রিকায় সেদিন ভুট্টোর কার্যকলাপের সমালোচনা করা হয়েছিল। সেখানে অতিসত্বর জনপ্রতিনিধিদের কাছে শাসনভার বুঝিয়ে দেয়ার অনুরোধ জানানো হয়। দেশমায়ের এই সঙ্কটময় সময়ে লেখক-শিল্পী-সংস্কৃতিকর্মীরা সক্রিয়ভাবে সম্পৃক্ত ছিলেন স্বাধীনতা অর্জনের লড়াইয়ে। কবি-কথাশিল্পী হাসান হাফিজুর রহমানের নেতৃত্বে ঢাকায় কবি-সাহিত্যিকরা গঠন করেছিলেন 'লেখক সংগ্রাম শিবির।' শিল্পী-সংস্কৃতিকর্মীরাও পিছিয়ে ছিলেন না। অগ্নিঝরা মার্চের প্রথম থেকেই বেতার, টেলিভিশন, চলচ্চিত্র_ সব মাধ্যমের শিল্পীই অসহযোগ আন্দোলনে অংশ নিয়ে মিটিং, মিছিল, গণসঙ্গীতের অনুষ্ঠান করে আসছিলেন। বিভিন্ন শিল্পী সংস্থা থেকে প্রতিনিধি নিয়ে গঠন করা হয়েছিল 'বিক্ষুব্ধ শিল্পী সংগ্রাম পরিষদ।'

এসবের পাশাপাশি পূর্ব পাকিস্তানের দামাল ছেলেরা সংঘবদ্ধ হচ্ছিল কঠিন সময় মোকাবেলা করতে। ঘরে ঘরে তখন একই সুর_ 'তোমাদের ঘরে যা কিছু আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকো, রক্ত যখন দিয়েছি, আরও রক্ত দেবো'_ এ স্পন্দন বাঙালী ছেলেদের মনেপ্রাণে উদ্দামতা এনে দেয়। বঙ্গবন্ধুর আহ্বান তাদের নতুন পথের দিশারী।

৯ মার্চ, ২০১০

৯ মার্চ, ২০১০

আজ ৯ মার্চ। ১৯৭১-এর উত্তাল-অগ্নিগর্ভ দিনগুলোর একটি। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের পর থেকে দেশ তাঁর নির্দেশনা অনুযায়ী চলতে থাকে। এই দিনে মিছিলে মিছিলে উত্তাল ছিল সারাদেশ। চরমে পৌছে দেশব্যাপী অসহযোগ আন্দোলন।

একাত্তরের এই দিনে ঢাকা শহর মিছিলের নগরীতে পরিণত হয়েছিল। যেখানে সেখানে জটলা, মিছিল, মিটিং চলতেই থাকে। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনা অনুযায়ী সারাদেশে দেশমাতৃকাকে শত্রুমুক্ত করে স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনতে যুবকরা ঐক্যবদ্ধ হতে থাকে। চলে বিভিন্ন স্থানে গোপন অস্ত্রের প্রশিক্ষণ, গেরিলা যুদ্ধের প্রস্তুতি।

বাংলাদেশের যুবকদের রক্তে তখন একই নেশা, 'এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম।' দু'চোখে দেশকে হানাদারমুক্ত করার স্বপ্ন। বাঙালীদের নতুন একটি দেশ। স্বাধীন একটা দেশ। তাই তাদের রক্তে বইতে থাকে টগবগে উত্তেজনা। শুধু অপেক্ষা পাকিস্তানী সামরিক বাহিনীর ওপর আক্রমণের মাধ্যমে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের। এদিকে সারাদেশে বঙ্গবন্ধুর ডাকে অসহযোগ আন্দোলন চরমে পৌঁছে। পাকিস্তানী শাসক গোষ্ঠী এই বাংলায় তাদের অস্তিত্বই হারিয়ে ফেলে। পাক সামরিক জান্তার কোন নির্দেশ কেউই মানে না। ধানমণ্ডির ৩২ নম্বর থেকে বঙ্গবন্ধু যেভাবে নির্দেশ দিচ্ছেন, সেভাবেই চলছে গোটা দেশ। এ জনপদের প্রতিটি মানুষ বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করছে।

সাধারণ মানুষ অপেক্ষায়, এরপর কী হবে? তরম্নণ-যুবক ছেলেরা সবাই মনেপ্রাণে প্রস্তুতি নিতে থাকে চূড়ান্ত ডাকের অপেক্ষায়। অন্যদিকে যুব সমাজকে সংগঠিত করতে সারাদেশেই সংগ্রাম কমিটি গঠিত হচ্ছে। অবসরপ্রাপ্ত বাঙালী সেনা অফিসার-সৈনিকরা গোপনে নানা স্থানে সশস্ত্র প্রশিক্ষণের মাধ্যমে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করতে থাকে স্বাধীনতার স্বপ্নে বিভোর বাঙালী দামাল ছেলেদের।

৮ মার্চ, ২০১০

৮ মার্চ, ২০১০

বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ডাক ও সশস্ত্র সংগ্রামের প্রস্তুতির নির্দেশে পুরোপুরি পাল্টে যায় পুরো দেশের চিত্র। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালনে উত্তাল বিক্ষুব্ধ বাংলায় বিদ্রোহ-সংগ্রামের তরঙ্গ টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া ছড়িয়ে পড়ে। বাঙালীর প্রচণ্ড বিক্ষোভে একাত্তরের এই দিনে রেডিও-টেলিভিশনে বঙ্গবন্ধুর অবিস্মরণীয় ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ প্রচার করতে বাধ্য হয় পাকি শাসকগোষ্ঠী।

চোখের সামনে সবাইকে বোকা বানিয়ে বঙ্গবন্ধুর কৌশলে স্বাধীনতার আহ্বানে হতভম্ভ হয়ে যায় পাকিস্তানী সামরিক জান্তারা। বঙ্গবন্ধুকে বিচ্ছিন্নতাবাদী বানিয়ে স্বাধীনতার আন্দোলনকে ভণ্ডুলের শেষ পরিকল্পনাও ব্যর্থ হওয়ায় হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে আন্দোলন-সংগ্রাম দমনের নীলনকশা অাঁটতে থাকে পাকি শাসক গোষ্ঠী।
আজ ৮ মার্চ। উনিশ শ' একাত্তরের এই দিনে বাংলার দামাল ছেলেরা চূড়ান্ত আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ার প্রস্তুতি নিতে থাকে। আর ৭ মার্চে দেয়া বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণে উদ্বুদ্ধ বাংলার জনগণ। বঙ্গবন্ধু যে স্বাধীনতার ডাক দিয়েছেন তার পরে দেশবাসী জেগে উঠতে শুরু করে। বাংলার দামাল ছেলেরা নিজেরা দলে দলে যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে প্রস্তুতি নিতে শুরু করে।

বঙ্গবন্ধুর ডাকে অসহযোগ আন্দোলন চলতেই থাকে। এ সময় স্বাধীনতা আন্দোলনের জন্য স্বাধীন বাংলাদেশ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।

অন্যদিকে বঙ্গবন্ধুর বাণী রেডিওতে প্রচার না করায় বাঙালী ক্ষোভে ফেটে পড়ে। বেতারকর্মীদের আন্দোলনের কারণে পাকিস্তানীরা বাধ্য হয় বঙ্গবন্ধুর ভাষণ বেতারে প্রচার করতে। ৮ মার্চ সকাল ৮টায় রেডিওতে ভেসে আসে বঙ্গবন্ধুর সেই অবিস্মরণীয় ভাষণ- 'এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।' অন্যদিকে আগের মতোই উত্তাল জনতা মিটিং-মিছিলে প্রকম্পিত করে রাখে সারাদেশ।

৭ মার্চ, ২০১০

৭ মার্চের ভাষণ পাকিস্তানী এক মেজরের দৃষ্টিতে

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ সেদিন বাঙালীদের স্বাধীনতার জন্য উজ্জীবিত করেছিল। রমনার রেসকোর্স ময়দানের জনসমুদ্রে তাঁর সেই ভাষণ আজও অমর বাণী হয়ে আছে। তাঁর সেই ভাষণ পরবর্তিতে রাজনৈতিক ও গবেষণার উপাদানে পরিণত হয়। বঙ্গবন্ধুর সেই ভাষণের প্রশংসা করেছেন ঢাকায় তৎকালীন পাক বাহিনীর জনসংযোগ কর্মকর্তা মেজর সিদ্দিক সালিক। খবর বাসসর।

মেজর সালিক তাঁর 'উইটনেস টু সারেন্ডার' বইতে বঙ্গবন্ধুর ভাষণের অকপটে প্রশংসা করেছেন। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের আগে ঢাকা গুজব, আতঙ্ক ও শঙ্কার নগরীতে পরিণত হয়েছিল। সে সময় পাকিস্তানের প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের সদর দফতর থেকে এ ধরনের বক্তব্য ঢাকা রেডিও স্টেশন থেকে প্রচার না করার নির্দেশ দেয়া হয়। মেজর বলেন, আমি নিজেই সেই বার্তা নিয়ে রেডিওতে গিয়েছিলাম। কিন্তু ওই সময় রেডিওতে দায়িত্ব পালনরত বাঙালী বন্ধু আমাকে জানান, সাড়ে সাত কোটি মানুষের মনের কথা যদি প্রচার করতে না পারি তাহলে আমি চাকরি করতে চাই না। এরপর তিনি রেডিওর সম্প্রচার বন্ধ করে দেন।

মেজর সিদ্দিক সালিক বলেন, বঙ্গবন্ধু সেই কালজয়ী ভাষণ দেয়ার জন্য ওই দিন বিকেলে ডায়াসে উঠে জনসমুদ্রের চারদিকে একবার তাকালেন। তারপর শুরু করলেন তাঁর সেই অগ্নিঝরা ভাষণ। তিনি এককভাবে স্বাধীনতার ঘোষণা দেননি। কিন্তু তিনি ২৫ মার্চে জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে যোগ দেয়ার জন্য চারটি পূর্বশর্ত আরোপ করলেন। তা হলো সামরিক আইন প্রত্যাহার করতে হবে, জনপ্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে, সেনাবাহিনীকে ব্যারাকে ফিরিয়ে নিতে হবে এবং যেসব বাঙালীকে হত্যা করা হয়েছে সেব্যাপারে বিচারবিভাগীয় তদন্ত করতে হবে। তাঁর সেদিনের বক্তব্য শুনতে যারা জড়ো হয়েছিল, বক্তব্য শোনার পর তাদের মনে হয়েছে যেন কোন মসজিদ বা গির্জা থেকে ধর্মীয় কোন সমাবেশ শেষে তাঁরা স্বন্তিতে বাড়ি ফিরছেন।

বঙ্গবন্ধু সেদিন জনতাকে ক্ষেপিয়ে দিয়ে ক্যান্টনমেন্টমুখী না করে যেভাবে রক্তপাত এড়িয়েছিলেন, মেজর সিদ্দিক সালিক তাঁর সেই প্রজ্ঞার ভূয়সী প্রশংসা করেন।

৭ মার্চ, ২০১০

রক্তঝরা একাত্তরের ঐতিহাসিক ৭ মার্চ আজ। এদিনে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন একটি ভিন্নমাত্রা পেয়েছিল। রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের স্বাধীনতার ডাকে রক্ত টগবগিয়ে উঠেছিল মুক্তিপাগল বাঙালীর। মুহূর্তেই উদ্বেল হয়ে ওঠে জনতার সমুদ্র। মুহুর্মুহু সেস্নাগানে কেঁপে ওঠে বাংলার আকাশ। নড়ে ওঠে হাতের ঝাণ্ডায় তাদের গর্বিত লাল-সবুজ পতাকা, পতাকার ভেতরে সোনালি রঙে অাঁকা বাংলাদেশের মানচিত্র। বঙ্গবন্ধুর এই ঐতিহাসিক ভাষণেই মুক্তিপাগল বাঙালী জাতিকে স্বাধীনতার জন্য সশস্ত্র যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে অনুপ্রাণিত করেছিল।

একাত্তরের এই ঐতিহাসিক দিনে কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের পূর্ববাংলা সমন্বয় কমিটি স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার লৰ্যে গেরিলা যুদ্ধের আহ্বান জানান। তাদের প্রচারপত্রে আহ্বান জানানো হয়- 'আঘাত হানো', 'সশস্ত্র বিপ্লব শুরু করো', 'জনতার স্বাধীন পূর্ববাংলা কায়েম করো'। পূর্ব পাকিস্তান ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি- ন্যাপ (মুজাফ্ফর) পাকিস্তানের শাসনতন্ত্রের জন্য ১৭ দফা প্রস্তাব দেয়। এতে বিচ্ছিন্ন হওয়ার অধিকারসহ আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার দাবি করা হয়।

৭ মার্চ ঢাকা ছিল লাখো মানুষের শহর। বিভিন্ন জেলা থেকে মানুষ ছুটে এসেছিল বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শোনার জন্য। 'বীর বাঙালী অস্ত্র ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো' শ্লোগানে ঢাকা শহর উত্তপ্ত হয়ে উঠেছিল। কখন ঘটবে বিস্ফোরণ এমন একটি পরিস্থিতি বিরাজ করে সারা শহরে। শেখ মুজিব নিজ মুখে স্বাধীনতার ঘোষণা করলে তাঁকে বিচ্ছিন্নতাবাদী বানিয়ে নির্বিচারে বাঙালী নিধনের ঘৃণ্য পরিকল্পনা বাসত্মবায়নে ভারি অস্ত্রেশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে প্রস্তুত ছিল পাকিস্তানী সামরিক বাহিনী। কিন্তু বঙ্গবন্ধু সে সুযোগ দেননি হানাদারদের। টানটান উত্তেজনার মধ্যে রেসকোর্সে অনুষ্ঠিত হয় এই সমাবেশ।

বিচ্ছিন্নতাবাদীর দায় চাপিয়ে দেশের স্বাধীনতাকে যাতে পাকিস্তানী সামরিক জান্তারা বিলম্বিত করতে না পারে সেজন্য বঙ্গবন্ধু পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ একটি ভাষণ দেন। সরাসরি না দিয়ে বঙ্গবন্ধু পরোক্ষোভাবে স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ার নির্দেশ দেন। আর বঙ্গবন্ধুর বজ্রনির্ঘোষ কণ্ঠে এ নির্দেশ পেয়েই নিরস্ত্র বাঙালী জাতি সশস্ত্র হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে পাকহানাদারদের বিরুদ্ধে। বাঙালীর দেশপ্রেমের অগ্নিশিখায় পরাস্ত করে প্রশিক্ষিত পাকিস্তানী সামরিক বাহিনীকে। এক সাগর রক্তের বিনিময়ে ছিনিয়ে আনে মহামূল্যবান স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ।

৬ মার্চ, ২০১০

৬ মার্চ, ২০১০

উনিশ শ' একাত্তর সালের ৬ মার্চেও বঙ্গবন্ধুর ডাকে ছিল হরতাল। সকাল ছ'টা থেকে দুপুর দু'টা পর্যন্ত। পাকিসত্মানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন একাত্তরের এদিন দুপুরে। তাঁর ভাষণ পূর্ণ ছিল বীর বাঙালীকে উদ্দেশে করে হুমকি ও ধমক। ছিল পাকি সামরিক বাহিনী দিয়ে বাঙালীকে শায়েস্তা করার হুমকি।
বাংলার মাটি দুর্জয় ঘাঁটি বুঝে নিক দুর্বৃত্ত_ বেপরোয়া বাঙালী তখন স্বাধীনতার স্বপ্নে যেমন উদ্দীপ্ত, তেমনি ফুঁসছিল বিদ্রোহ, বিক্ষোভ ও ঘৃণায়।

পরদিন ৭ মার্চ তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে ঐতিহাসিক ভাষণ দেবেন বাঙালীর মুক্তির দিশারী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ভাষণে তিনি কী বলবেন? বহুল আকাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতার ঘোষণা তাঁর বর্জ্রকণ্ঠে উচ্চারিত হবে কি? এ নিয়ে জল্পনা-কল্পনার অন্ত ছিল না সাড়ে ৭ কোটি বাঙালীর মধ্যে।

একাত্তরের পহেলা মার্চ বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, বাংলার মানুষের আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার অর্জনের কর্মসূচী ৭ মার্চ ঘোষণা করা হবে। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণের একদিন আগে পাকিসত্মানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার হুমকিধমকি স্বাধীনতাকামী বাঙালীকে হতাশ, ক্ষুব্ধ ও উত্তেজিত করে তোলে। এমনিতেই বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে লাগাতার হরতাল ও অসহযোগ আন্দোলন চলছে। পাকি প্রেসিডেন্টের ভাষণের পর তা নতুন মাত্রা পায়। ঘর থেকে রাজপথে নেমে আসে বিক্ষুব্ধ হাজার হাজার স্বাধীনতাকামী বাঙালী। সাড়ে সাত কোটি বাঙালীর অধীর অপেক্ষা; দৃষ্টি রেসকোর্সের ময়দানে আয়োজিত জনসভার দিকে।

৫ মার্চ, ২০১০

৫ মার্চ, ২০১০

উনিশ শ' একাত্তরের মার্চের এই দিনে স্বাধিকার চেতনায় শাণিত আন্দোলনমুখর ছিল বাঙালী জাতি। বাংলাদেশ তখন বিদ্রোহ-বিক্ষোভে টালমাটাল, বীর বাঙালী স্বাধীনতার আকাঙ্ৰায় দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।

রক্তঝরা পহেলা মার্চ ঢাকায় যে আন্দোলন শুরু হয়েছিল, তার ঢেউ আছড়ে পড়েছে দেশের প্রতিটি পাড়া-মহলস্না, শহর-বন্দরে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অঙ্গুলি হেলনে চলছে সবকিছু। পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠীর কোন নির্দেশই মানেনি মুক্তিপাগল বাঙালীরা। দেশ স্বাধীন না হলেও তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের সবকিছু নিয়ন্ত্রণে চলে যায় বঙ্গবন্ধুর।

বঙ্গবন্ধুর ডাকে টানা হরতাল চলছে। অহিংস আন্দোলন ক্রমশ সশস্ত্র প্রতিরোধে রূপ নিতে শুরু করে। দেশের বিভিন্ন স্থানে স্বাধীন বাংলাদেশের মানচিত্র খচিত লাল-সবুজ পতাকা নিয়ে রাজপথ উত্তপ্ত করছে বীর বাঙালী। পাক সেনাবাহিনী ও সামরিক জান্তার রক্তচক্ষু উপেক্ষা করেই স্বাধীনতার দাবিতে অগ্নিগর্ভ হতে থাকে পুরো বাংলাদেশ। পাক সামরিক বাহিনীর সামনেই মুক্তিপাগল বাঙালী জাতি প্রকাশ্য রাজপথে "বীর বাঙালী অস্ত্র ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো"-শ্লোগানে মুখরিত গোটা দেশ।

উনিশ শ' একাত্তর সালের ৫ মার্চের দিনটি কেমন ছিল? এ প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাবে শহীদ জননী জাহানারা ইমামের লেখা বিখ্যাত প্রামাণ্য গ্রন্থ "একাত্তরের দিনগুলি'তে। শহীদ জননী তাঁর গ্রন্থে একাত্তরের ৫ মার্চ শুক্রবারের বর্ণনা দিয়েছেন এভাবে-
"আজও ছ'টা দুটো হরতাল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব হরতালের দিনগুলোতে বেতন পাওয়ার সুবিধার জন্য এবং অতি জরম্নরী কাজকর্ম চালানোর জন্য সরকারী-বেসরকারী সব অফিস দুপুর আড়াইটা থেকে চারটা পর্যন্ত খোলা রাখার নির্দেশ দিয়েছেন। রেশন দোকানও ঐ সময় খোলা।
ব্যাংকও তাই। আড়াইটা-চারটার মধ্যে টাকা তোলা যাবে। তবে দেড় হাজার টাকার বেশি নয়। বিকেলে ব্যাংক খোলা_ভাবতে মজাই লাগছে। শেখ মুজিবের একেকটা নির্দেশ সব কেমন ওলটপালট খেয়ে যাচ্ছে।

জরুরী সার্ভিস হিসাবে হাসপাতাল, ওষুধের দোকান, এ্যাম্বুলেন্স, ডাক্তারের গাড়ি, সংবাদপত্র ও তাদের গাড়ি, পানি, বিদ্যুত, টেলিফোন, দমকল, মেথর ও আবর্জনা ফেলা ট্রাক- এগুলোকে হরতাল থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। আজ মসজিদ ও মন্দিরে বিশেষ প্রার্থনা।"

৪ মার্চ, ২০১০

৪ মার্চ ১৯৭১

উনিশ শ' একাত্তরের অগ্নিঝরা মার্চের চার তারিখ ছিল দেশব্যাপী লাগাতার হরতালের তৃতীয় দিন। তবে এই দিন হরতাল ছিল আট ঘণ্টার। দ্রোহ-ক্ষোভে বঞ্চিত শোষিত বাঙালী তখন ক্রমেই ফুঁসে উঠছিল ঔপনিবেশিক পাকিসত্মানী শাসক-শোষকদের বিরম্নদ্ধে।

এৰেত্রে বসে নেই কুখ্যাত পাকিস্তানী বাহিনীর। কার্ফু দিয়েও সামরিক জান্তারা সাহসী বীর বাঙালীদের ঘরে আটকে রাখতে না পেরে গোপনে অাঁটতে থাকে নির্মম ও নিষ্ঠুরভাবে বাঙালী নিধনের পরিকল্পনা। শুধু অপেৰা করতে থাকে ৭ মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব কী বলেন তা শোনার জন্য।

আন্দোলনের পাশাপাশি আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতারা দফায় দফায় বৈঠকে বসেন ৭ মার্চের জনসভা সফল করার জন্য। তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহ্্রাওয়াদর্ী উদ্যান) চলতে থাকে জনসভার প্রস্তুতি। পাশাপাশি ঢাকাসহ সারাদেশেই গঠন হতে থাকে সংগ্রাম কমিটি। অন্যদিকে আওয়ামী লীগের যুব ও ছাত্র নেতারা গোপনে নানা স্থান থেকে অস্ত্র সংগ্রহ অভিযান চালাতে থাকেন বেশ জোরেশোরেই। একাত্তরের এই দিনে অর্থাৎ ৪ মার্চ, ১৯৭১ ৰুব্ধ বাঙালীর মিছিলে মিছিলে ঝাঁঝাল সেস্নাগানে উচ্চকিত ছিল সারাদেশ। প্রধান সেস্নাগান ছিল- 'বীর বাঙালী অস্ত্র ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো', 'তোমার আমার ঠিকানা, পদ্ম-মেঘনা-যমুনা', 'তোমার দেশ আমার দেশ, বাংলাদেশ বাংলাদেশ।'

একাত্তরের উত্তাল, ঝঞ্ঝাবিৰুব্ধ এই দিনটিতে সারাদেশের সকল পাড়া, গ্রাম, মহলস্নায় সংগ্রাম কমিটির পাশাপাশি শানত্মি-শৃঙ্খলা রৰা কমিটি এবং স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গঠনের আহ্বান জানানো হয়। এর উদ্যোক্তা ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) ও আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগ। এ ছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন ইকবাল হলের (বর্তমান সার্জেন্ট জহুরম্নল হক হল) ক্যান্টিনে স্থাপন করা হয় ছাত্রদের যোগাযোগ কেন্দ্র।

৩ মার্চ, ২০১০

৩ মার্চ ১৯৭১

একাত্তরের এ দিনে মুক্তিকামী শোষিত-বঞ্চিত বাঙালী ছিল বিৰুব্ধ, প্রতিবাদমুখর। পাকিস্তানী শাসকদের কার্ফু অগ্রাহ্য করে ঢাকাসহ সর্বত্র অসংখ্য মিছিল হয়েছে। সংবাদপত্রে যাতে দুর্বার আন্দোলনের খবর প্রকাশিত হতে না পারে সেজন্য সামরিক জানত্মা সেন্সরশিপ আরোপ করেছিল একাত্তরের এ দিনে। বঙ্গবন্ধুর ডাকে অহিংস অসহযোগ আন্দোলন চলছিল বাংলার সর্বত্র।

এদিকে একাত্তরের ১ মার্চ থেকেই বাঙালী জাতির দৃষ্টি ছিল ৭ মার্চ ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু কী ঘোষণা দেন_ সেদিকে। আর পাকিসত্মানের শোষণ-বঞ্চনা নয়, চাই মুক্ত স্বাধীন বাংলাদেশ। এই মুক্তির প্রত্যাশায় দেশের বিভিন্ন স্থানে গঠিত হতে থাকে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম পরিষদ। গোপনে চলে সশস্ত্র সংগ্রামের প্রস্তুতি। এসব সংগ্রাম কমিটির ব্যানারে যোগ দিতে থাকে মুক্তির স্বপ্নে বিভোর দেশের তরতাজা বাঙালী যুবকরা। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ পেলেই দেশমাতৃকাকে মুক্ত করতে যে কোন আত্মত্যাগে প্রস্তুতি নিতে থাকে বাঙালীরা।
অগি্নগর্ভ মার্চের বাঙালীর প্রবল আন্দোলনে দিশেহারা হয়ে পড়ে পাকিসত্মানী সামরিক জানত্মারা। কিভাবে বাঙালীর এই আন্দোলন কঠোরভাবে দমন করা যায় সে ব্যাপারে নীলনকশা করতে থাকে সামরিক জানত্মা ও তাদের এ দেশীয় দোসররা। বিশ্বের কাছে স্বাধীনতার জন্য বাঙালীর এই বাঁধভাঙ্গা আন্দোলন-সংগ্রামের খবর যাতে কোনভাবেই যেতে না পারে সে জন্য তৎপর হয়ে ওঠে পাকি জেনারেলরা। শুধু সেন্সরশিপ আরোপই নয়, কোনভাবেই যাতে বাঙালীর আন্দোলন-সংগ্রামের খবর না ছাপা হয় সে জন্য প্রতিটি সংবাদপত্রের অফিসে ফোন বা স্বশরীরে গিয়ে হুমকি-ধমকিও দেয়া হয়।

বাঙালী জাতির এমনই আন্দোলন-সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় শুরম্ন হয়েছিল প্রাণঘাতী সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ। প্রশিৰিত পাকিসত্মানী সামরিক বাহিনীকে পরাসত্ম করে বীর বাঙালী বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ছিনিয়ে এনেছিল মহামূল্যবান স্বাধীনতা_ স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ। কৃতজ্ঞ বাঙালী জাতি তাই নানা কর্মসূচীর মাধ্যমে স্মরণ করছে দেশমাতৃকার জন্য আত্মোৎসর্গকারী বীর মুক্তিযোদ্ধাদের।

আ স ম আবদুর রবের নেতৃত্বাধীন জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল- জেএসডি গতকাল ২ মার্চ প্রথম স্বাধীনতার পতাকা উত্তোলন দিবস পালন করে। এ উপলৰে ঢাকা মহানগর নাট্যমঞ্চে আয়োজিত আলোচনাসভা থেকে সরকারীভাবে এ দিনটি পালনের দাবি জানানো হয়। বক্তারা বলেন, ১৯৭১ সালের ২ মার্চ ছাত্র সমাজের পৰ থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বটতলায় তৎকালীন ডাকসু ভিপি আ স ম আবদুর রব স্বাধীনতার পতাকা উত্তোলন করেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাস এ পতাকাকেই বাংলাদেশের পতাকা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তাই স্বাধীনতার ইতিহাসে ২ মার্চ এক অনন্য দিন।

২ মার্চ, ২০১০

২ মার্চ ১৯৭১

একাত্তরের এই দিনে ঢাকাসহ পুরো বাংলাদেশ পরিণত হয়েছিল এক বিক্ষুব্ধ জনপদে। এদিন ওড়ানো হয়েছিল মানচিত্র খচিত স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম পতাকা। এর আগের দিন ১ মার্চ পাকিস্তানের তৎকালীন শাসক ইয়াহিয়া খান এক ফরমানের মাধ্যমে জাতীয় পরিষদ অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করে দেন। তাঁর সেই অবৈধ এবং স্বৈরাচারী ঘোষণার মাধ্যমে বাঙালী জাতির কাছে স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল যে নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতিতে সংখ্যাগরিষ্ঠের প্রতিনিধি ক্ষমতায় যেতে পারবে না। স্বাধীনতার আন্দোলন শুরু করা ছাড়া অধিকার আদায়ের আর কোন বিকল্প নেই। পাকিস্তানী শাসকদের এই মনোভাবের বিস্ফোরণ ঘটেছিল ২ মার্চ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে হাজার হাজার ছাত্র এদিন বটতলায় এসে জমায়েত হন। বটতলার সমাবেশে ইয়াহিয়ার স্বৈরাচারী ঘোষণার ধিক্কার জানানো হয় এবং স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়। বটতলার ঐতিহাসিক সমাবেশে তৎকালীন ডাকসুর ভিপি আ স ম আবদুর রব স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকাটি উত্তোলন করেন। স্বাধীনতা সংগ্রামের ৯ মাস এই পতাকাই বিবেচিত হয়েছে আমাদের জাতীয় পতাকা হিসেবে। এদিকে বঙ্গবন্ধুর ডাকে তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দি উদ্যান) আহূত ৭ মার্চের ঐতিহাসিক জনসভা সর্বাত্মকভাবে সফল করার প্রস্তুতি চালায় আওয়ামী লীগ। আর এই জনসভাকে কেন্দ্র করে মুক্তিপাগল বাঙালীর মধ্যে এক অন্য ধরনের গণজাগরণের সৃষ্টি হয়। পাক হানাদার বাহিনীর কর্তা ব্যক্তিদের ললাটেও তখন চিনত্মার বলিরেখা। ওই জনসভায় বঙ্গবন্ধু কী স্বাধীনতার ডাক দেবেন? দিলে কি পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে- এ নিয়ে পুরো পাকিসত্মানেই তোলপাড় চলছিল। একদিকে জনসভার প্রস্তুতি, অন্যদিকে গোটা বাংলাদেশেই উত্তাল আন্দোলন-বিৰোভে রীতিমতো অগ্নিগর্ভ অবস্থার সৃষ্টি হয়। প্রতিটি বাঙালীর চোখেমুখে একই প্রত্যাশা_ পাকিস্তানী দখলদারদের হটিয়ে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ ছিনিয়ে আনা। আর সেই লৰ্য পূরণেই বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাঙালীর দামাল ছেলেরা সশস্ত্র প্রতিরোধের প্রস্তুতি নিতে শুরম্ন করে।

৩০ মার্চ, ২০০৯

সংক্ষেপে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস এক দীর্ঘকালীন সংগ্রামের ইতিহাস। অসংখ্য রাজনৈতিক সামাজিক সংগ্রামের ঘটনা এক দীর্ঘ ধারাবাহিকতা শেষে নতুন দেশের জন্মের মাধ্যমে শেষ হয়। স্বল্প পরিসরে কিংবা সংক্ষিপ্ত আকারে এর কাহিনী বর্ণনা করা সম্ভব করা কঠিন। সেই কঠিনকেই সম্ভবপর করে তুলেছেন জনপ্রিয় সাহিত্যিক, বিজ্ঞানী, মানবতাবাদী, সংগ্রামী শিক্ষক মুহম্মদ জাফর ইকবাল।

মাত্র ২২ পাতার মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের সুদীর্ঘ ইতিহাসকে সহজ করে তুলে ধরেছেন। রচনা করলেন আর এক ইতিহাস। এই অসামান্য সংকলন গ্রন্থটির মূল্য মাত্র ১০/= করে রাখা হচ্ছে। আগ্রহীরা মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর থেকে এর অনেকগুলো কপি কিনুন ও বন্ধুদেরকে উপহার দিন, পাড়ায় ছোট্টদের মধ্যে মজার মজার প্রতিযোগিতার আয়োজন করে পুরস্কার হিসেবে দিন, বিভিন্ন দিবসের আবশ্যক উপহার হিসেবে নির্দিষ্ট করে রাখুন।

নতুন প্রজন্মের জন্য সহজ সরল ভাষায়, ভালোবাসার সাথে জাফর ইকবালের মতো করে কে ভাবে? আর কেই বা সেরকম দরদ দিয়ে বলতে পারে? শিশু-কিশোরদের মধ্যে জনপ্রিয়তা পাওয়া এই বইটির ডিজিটাল কপিও পাওয়া যাচ্ছে। সম্পূর্ণ বিনামূল্যে এই বইটি পিডিএফ (PDF) কপি হিসেবে দুইরকম সাইজে ডাউনলোড করুন।

বড় সাইজ (আকার: ৩.৭৬ মে.বা.)
ছোট সাইজ (১.২৫ মে.বা.)

( পাশের সাইডবারে দেয়া পিডিএফ ফাইলটি ছোট সাইজের)
কৃতজ্ঞতা: www.liberationwarbd.org

২৭ ডিসেম্বর, ২০০৮

নির্বাচনে যুদ্ধাপরাধী প্রার্থীরা- ০৯

মাওলানা হাবিবুর রহমান

চুয়াডাঙ্গা প্রতিনিধি

দামুড়হুদা, জীবননগর ও চুয়াডাঙ্গা সদর নিয়ে গঠিত চুয়াডাঙ্গা-২ আসনে এবার চারদলীয় জোটের প্রার্থী জামায়াত জেলা ও কেন্দ্রীয় কমিটির মজলিসে শূরা সদস্য মাওলানা হাবিবুর রহমান।

একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি ছিলেন জীবননগর শান্তি কমিটির সদস্য। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু সরকারের সময় দালাল আইনে যে ৭৫২ যুদ্ধাপরাধীর বিভিন্ন মেয়াদে শাস্তি হয়েছিল তাদের মধ্যে এই হাবিবুর রহমানও ছিলেন। ১৯৭২ সালের ১ জানুয়ারি তাকে দালাল আইনে গ্রেফতার করা হয়। পরে জিয়াউর রহমান সরকার দালাল আইন বাতিল করলে অন্যদের সঙ্গে তিনিও ছাড়া পান।

১৯৯৯ সালে বাংলাদেশ রিসার্চ অ্যান্ড পাবলিকেশন্সের প্রকাশিত এএসএম সামছুল আরেফিন সংকলিত ও সম্পাদিত ‘রাজাকার ও দালাল অভিযোগে গ্রেফতারদের তালিকা, ডিসেম্বর ’৭১-মার্চ ’৭২’ গ্রন্থের উদ্ধৃতি দিয়ে রাজীব আহমেদ সম্পাদিত ‘চুয়াডাঙ্গায় মুক্তিযুদ্ধ প্রত্যক্ষ বিবরণ’ গ্রন্থের ৬২ পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে- ‘রাজাকার ও
দালাল হিসেবে চুয়াডাঙ্গা জেলায় (তৎকালীন মহকুমা) গ্রেফতার ১১৬ জনের তালিকা সন্নিবিষ্ট করা হয়েছে। স্থানীয় জনগণ এদের কর্তৃপক্ষের কাছে সোপর্দ করেন অথবা জনগণের সহযোগিতায় মুক্তিবাহিনী বা আইন প্রয়োগকারী কর্তৃপক্ষ এদের গ্রেফতার করেন।’

ওই গ্রন্থে গ্রেফতারদের যে তালিকা প্রকাশিত হয়েছে তার জীবননগর থানা অংশে মাওলানা হাবিবুর রহমানের নাম উল্লেখ রয়েছে।

এছাড়াও রাজীব আহমেদের ‘বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধা চুয়াডাঙ্গা জেলা’ শীর্ষক গ্রন্থে বলা হয়েছে, ...জীবননগরের ডা. শামসুজ্জোহা প্রথমদিকে শান্তি কমিটির সভাপতি ও পরে মাওলানা হাবিবুর রহমান শান্তি কমিটির সভাপতি হয়। (পৃ. ৩০০)।

এছাড়া জীবননগরের মুক্তিযোদ্ধা শাহাবুদ্দিন ও জীবননগর কলেজের প্রভাষক মুক্তিযোদ্ধা নজরুল ইসলামসহ স্থানীয় অনেকে জানিয়েছেন, একাত্তরে জীবননগরে পাকসেনাদের একটি শক্তিশালী ঘাঁটি ছিল। সে ঘাঁটির মূল নিয়ন্ত্রক ছিলেন মাওলানা হাবিবুর রহমান। তিনি স্বাধীনতাবিরোধীদের নেতৃত্ব দিতেন। তার নেতৃত্বেই কয়া গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা আবদুর রাজ্জাককে হাসাদহ ক্যাম্পে নিয়ে হত্যা করে লাশ গুম করা হয়।

স্বাধীনতার পর মিলাদ-মাহফিল ও ধর্মীয় সভায় বক্তব্য দিয়ে এলাকার মানুষের কাছে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন মাওলানা হাবিবুর রহমান। সেটি পুঁজি করে জাতীয় রাজনীতিতে জায়গা করে নেন তিনি। ’৯১ সালে সংসদ নির্বাচনে এই আসনে জামায়াতের প্রার্থী হিসেবে ৪৯ হাজার ৬৮৫ ভোট পেয়ে জয়লাভ করেন তিনি। ওই নির্বাচনে তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন বিএনপির মোজাম্মেল হক। তিনি পেয়েছিলেন ৪০ হাজার ২০ ভোট।
কামিল পাস মাওলানা হাবিবুর রহমানের ছাত্রজীবন কাটে কুমিল্লায়। সেখান থেকেই দাখিল পাস করেন তিনি। ছাত্রজীবন থেকেই তিনি জামায়াতের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত। এক সময় জেলা জামায়াতের নায়েবে আমির ছিলেন তিনি।

স্বাধীনতা যুদ্ধে মাওলানা হাবিবুর রহমানের ভূমিকা প্রসঙ্গে জামায়াতের জেলা আমির আনোয়ারুল হক মালিক বলেন, ‘ওই সময় পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে মাওলানা হাবিবুর রহমানের বেশ সখ্য ছিল। অনেককে তিনি পাকবাহিনীর হাত থেকে বাঁচিয়েছেন। পাকবাহিনী কাউকে ধরে নিয়ে গেলে তিনি ছাড়িয়ে এনেছেন, এমন অনেক নজির আছে। যুদ্ধের সময় কিংবা পরবর্তী সময়ে তিনি কারো ক্ষতি করেননি।’

মাওলানা হাবিবুর রহমান সমকালকে জানান, কয়া গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা রাজ্জাককে তিনি চেনেন না। ওই সময় পাকবাহিনী রাজ্জাক নামে কোনো মুক্তিযোদ্ধাকে হত্যা করেছে কি-না তাও তিনি জানেন না। তিনি বলেন, ‘আমার জনপ্রিয়তায় ঈর্ষান্বিত হয়ে অপপ্রচার চালানো হচ্ছে।’

চুয়াডাঙ্গা-২ নির্বাচনী এলাকার অনেক ভোটার অভিযোগ করেছেন, ’৯১ সালের নির্বাচনে জয়লাভের পর হাবিবুর রহমান এলাকার কোনো উন্নয়ন করেননি। গলাইদড়ি ঘাটের ওপর একটি ব্রিজ নির্মাণ ছাড়া এ সময়ে তার আর কোনো কাজ নেই।

দৈনিক সমকাল, ১৮ ডিসেম্বর, ২০০৮

নির্বাচনে যুদ্ধাপরাধী প্রার্থীরা- ০৮

আবদুস সুবহান মিয়া

সমকাল প্রতিবেদক

পাবনা শহরের পাথরতলা মহল্লার মৃত নইমুদ্দিনের ছেলে আবুল বসর মোহাম্মদ আবদুস সুবহান মিয়া এবারের সংসদ নির্বাচনে পাবনা-৫ (সদর) আসনে জামায়াত তথা চারদলীয় জোট প্রার্থী। জামায়াতের সংসদীয় দলের এই সাবেক উপ-নেতা ‘মাওলানা সুবহান’ নামেই বেশি পরিচিত। তার বিরুদ্ধে রয়েছে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে সহযোগিতা, বুদ্ধিজীবী হত্যা ও গণহত্যার সুনির্দিষ্ট অভিযোগ।

১৯৭১ সালে তিনি ছিলেন পাবনা জেলা জামায়াতের ভারপ্রাপ্ত আমির। তাছাড়া তিনি ছিলেন পাবনা শান্তি কমিটির ভাইস প্রেসিডেন্ট। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর অত্যন্ত আস্থাভাজন একজন সহযোগী ছিলেন তিনি। উর্দুতে কথা বলতে পারায় মাওলানা সুবহানের সঙ্গে পাকিস্তানি সেনাদের খুব তাড়াতাড়ি সখ্য গড়ে উঠেছিল বলে মনে করা হয়। তার ইঙ্গিতে পাবনা শহরের শত শত মানুষকে পাকবাহিনী হত্যা করে। ‘একাত্তরের ঘাতক দালাল ও যুদ্ধাপরাধীদের সম্পর্কে জাতীয় গণতদন্ত কমিশনের দ্বিতীয় রিপোর্ট’-এ (সংক্ষিপ্ত ভাষ্য) বলা হয়, ‘মাওলানা সুবহানের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় পাবনার আল বদর, রাজাকার এবং শান্তি কমিটি গঠিত হয়। মাওলানা সুবহান উর্দু ভাষায় অনর্গল কথা বলতে পারতেন বলে পাকিস্তানি বাহিনীর খুব কাছাকাছি আসতে সমর্থ হন এবং নীতিনির্ধারক হিসেবে স্বাধীনতা যুদ্ধবিরোধী ভূমিকায় তার সার্বিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করেন।’

স্থানীয় সাংবাদিক শফিকুল ইসলাম শিবলী জানান, বীর মুক্তিযোদ্ধা মাওলানা কসিমুদ্দিনকে মাওলানা সুবহানের নির্দেশে হত্যা করা হয়। এছাড়া পাবনার এডওয়ার্ড কলেজের প্রফেসর হারুন, ডাক্তার অমলেন্দু দাক্ষি, সাবেক এমএনএ এবং আওয়ামী লীগ নেতা আমিনুদ্দিন, ব্যবসায়ী আবু সাইদ তালুকদারকে মাওলানা সুবহানের নির্দেশেই হত্যা করা হয়। এছাড়া মাওলানা সুবহানের লোকজন সঙ্গীতশিল্পী সাধনকে ধরে নিয়ে গিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করে। পাবনা শহরের কালাচাঁদপাড়া এলাকায় মাওলানা সুবহানের নেতৃত্বে সুধীর চন্দ্র চৌধুরী, অশোক কুমার সাহা, গোপাল চন্দ্র চৌধুরীসহ ১১ ব্যক্তিকে গুলি করে হত্যা করা হয় বলে জানান শফিকুল ইসলাম শিবলী।

পাবনা জেলা বিএনপির সিনিয়র সহ-সভাপতি মুক্তিযোদ্ধা জহুরুল ইসলাম বিশু বলেন, ১৯৭১ সালের মে মাসের প্রথম সপ্তাহে মাওলানা সুবহানের নেতৃত্বে সুজানগরের নাজিরগঞ্জে ৪০০ নিরীহ ব্যক্তিকে হত্যা করা হয়। পরে ওই হত্যাযজ্ঞের অন্যতম নায়ক রাজাকার মৌলভী মধুকে মুক্তিযোদ্ধারা ধরে নিয়ে হত্যা করে। মৃত্যুর আগে মৌলভী মধু মুক্তিযোদ্ধাদের বলেন, পাবনা জেলায় যত হত্যাকা- হয়েছে তার সবই হয়েছে মাওলানা সুবহানের নির্দেশে। এছাড়া সুবহানের নেতৃত্বে ফরিদপুর উপজেলার ডেমরায় প্রায় ১ হাজার নিরীহ মানুষকে হত্যা করা হয়। যুদ্ধে পরাজয় অবধারিত বুঝতে পেরে ১৯৭১ সালের ৪ ডিসেম্বর মাওলানা সুবহান পাকিস্তান হয়ে সৌদি আরব পালিয়ে যান। মাওলানা আবদুস সুবহান সম্পর্কে গণতদন্ত রিপোর্টে আরো বলা হয়, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে মাওলানা সুবহানের বাংলাদেশের স্বাধীনতা, বাঙালি জাতিসত্তাবিরোধী ভূমিকা, মুক্তিযোদ্ধাদের সমূলে ধ্বংস করার লক্ষ্যে আলবদর, রাজাকার, শান্তি কমিটি গঠন করে ৩০ লাখ নিরীহ, নিরস্ত্র, শান্তিকামী মানুষ হত্যায় সহায়তা এবং পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর যাবতীয় নৃশংস কার্যকলাপে সহায়তার জন্য তার বিরুদ্ধে ’৭২ সালে স্পেশাল ট্রাইব্যুনালে মামলা রুজু করা হয়। ২৯ ফেব্রুয়ারি, ১৯৭২ সালে বিকেল ৩টায় তাকে পাবনার মহকুমা ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে হাজির হতে বলা হয়। কিন্তু সে সময় তিনি গোলাম আযমের সঙ্গে পাকিস্তান পালিয়ে গিয়েছিলেন। (সূত্র : ‘একাত্তরের দালালরা’ : শফিক আহমেদ এবং অ্যাডভোকেট শফিকুল ইসলাম শিবলী, পাথরতলা, পাবনা)। ’৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে রাজধানী ঢাকার মতো পাবনাতেও পাকিস্তান বাহিনী অতর্কিতে নিরীহ বাঙালির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। তবে পাবনার অবস্থা ছিল একটু ব্যতিক্রম। তদন্তকালে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক প্রত্যক্ষদর্শী একজন মধ্যবয়স্ক মহিলা জানান, ’৭১ সালের ২৫ মার্চ রাত থেকেই পাবনার গণ্যমান্য বরেণ্য ব্যক্তিদের স্থানীয় দালালদের সহযোগিতায় পাকিস্তানি আর্মি বাড়ি বাড়ি গিয়ে ধরে নিয়ে আসে। ২৬ মার্চ বিকেল আনুমানিক ৩টার ঘটনা। একজন মহিলা তখন পাবনা রায়েরবাজারের প্রধান সড়কের ধারে একটি পুরনো বাড়ির দোতলার জানালায় দাঁড়িয়ে ছিলেন। জানালার খড়খড়ি দিয়ে দেখছিলেন ভীত-সন্ত্রস্ত পাবনা শহর। হঠাৎ তিনি পাকিস্তানি আর্মির একটি লরি রাস্তার ওপর থামতে দেখেন। লরির পেছনে লম্বা দড়ি দিয়ে বাঁধা প্রায় ১০০ মানুষ, যাদের পাকা রাস্তার ওপর দিয়ে টেনে আনা হয়েছে। প্রত্যেক বন্দির জামা-কাপড় ছিন্নভিন্ন, তাদের হাঁটু থেকে পায়ের পাতা পর্যন্ত সাদা হাড় দেখা যাচ্ছিল আর শরীর ছিল রক্তে মাখামাখি। লরির ভেতরে তিনি পাকিস্তানি আর্মিদের সঙ্গে মাওলানা আবদুস সুবহানকে বসা দেখেছিলেন তিনি। আর যাদের সিমেন্টের রাস্তার ওপর দিয়ে টেনেহেঁচড়ে আনা হচ্ছিল তাদের মধ্যে তিনি পাবনার বিশিষ্ট ব্যবসায়ী আবু সাঈদ তালুকদার, এডওয়ার্ড কলেজের প্রফেসর হারুন, বিশিষ্ট দন্ত চিকিৎসক অমলেন্দু দাক্ষি এবং অ্যাডভোকেট ও আওয়ামী লীগের নেতা আমিনউদ্দিনকে চিনতে পেরেছিলেন। লরি থেকে নেমে কিছু সৈন্য কয়েকটি দালানের ওপর ওড়ানো বাংলাদেশের পতাকা নামানো এবং পোড়ানোর ব্যবস্থা করে চলে যায়। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক, ভীতসন্ত্রস্ত ওই মহিলা জানান, ২৯ মার্চ ’৭১ সালের মধ্যে তার দেখা ওইসব পরিচিত ব্যক্তির সবাইকে মেরে ফেলা হয়। তিনি আরো বলেন, ২৬ তারিখে এ দৃশ্য দেখার পর ২৭ মার্চ অমলেন্দু দাক্ষির বাড়িতে গিয়ে তার স্ত্রীর কাছ থেকে জানতে পারেন, দন্ত চিকিৎসক অমলেন্দু দাক্ষির বাড়িতে মাওলানা আবদুস সুবহান পাকিস্তানি আর্মিদের নিয়ে এসেছিলেন।

পাবনা জজকোর্টের সিনিয়র অ্যাডভোকেট, সাবেক পাবলিক প্রসিকিউটর এবং আওয়ামী লীগের প্রধান নেতা আলহাজ গোলাম হাসনায়েন (কাচারীপাড়া, পাবনা) বলেন, ‘মাওলানা আবদুস সুবহান আওয়ামী লীগ নেতা আমিনউদ্দিন সাহেবের বাসা পাক আর্মিদের চিনিয়ে দিয়েছিল।’ তিনি আরো বলেন, ‘পাবনার আলবদর, রাজাকার, শান্তি কমিটির সব সদস্যকে মাওলানা সুবহান সংগ্রহ করেছিলেন।’

অবসরপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মোঃ আবদুল গনি (কালাচাঁদপাড়া, পাবনা) জানান, ‘১৭ এপ্রিল দুপুরে হিন্দু অধ্যুষিত এলাকা কুচিয়াপাড়া ও শাঁখারীপাড়ায় মাওলানা আবদুস সুবহান পাকিস্তানি আর্মিদের সঙ্গে নিয়ে অপারেশন চালান। ওইদিন সেখানে সুধীরচন্দ্র চৌধুরী, অশোক কুমার সাহা, গোপালচন্দ্র চৌধুরীসহ ৮ জনকে হত্যা করা হয়। তারা ২০/২৫টি ঘর পোড়ানো এবং সে সঙ্গে লুটতরাজ ও নারী নির্যাতনও করেছিল।’ অধ্যক্ষ আবদুল গনি আরো বলেন, ‘মে মাসে পাবনা-ফরিদপুর থানার ডেমরাতে মাওলানা আবদুস সুবহান, মাওলানা ইসহাক, টেগার ও আরো কয়েকজন দালালের একটি শক্তিশালী দল পাকিস্তানি আর্মিকে নিয়ে ব্যাপক গণহত্যা করে। সেখানে ওইদিন আনুমানিক ১০০০ মানুষ হত্যাসহ ঘরবাড়ি পোড়ানো, লুণ্ঠন, নারী নির্যাতন ইত্যাদি করা হয় (সূত্র : গণতদন্ত কমিশন রিপোর্ট)।

পাবনার দ্বিতীয় বৃহত্তম গণহত্যাটি হয় সুজানগর থানায়। ‘মে মাসের প্রথমদিকে এক ভোরে নাজিরগঞ্জ-সাতবাড়িয়া ইউনিয়নের হত্যা করা হয় প্রায় ৪০০ জনকে’- বলেন মুজিব বাহিনীর সুজানগর থানা লিডার এবং ঢাকার ব্যবসায়ী জহিরুল ইসলাম বিশু। তিনি জানান, সুজানগর হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ও শান্তি কমিটির একজন সদস্য মৌলভী মধুকে তারা ’৭১-এর মে মাসের শেষদিকে গ্রেফতার করেন এবং পরে মেরে ফেলেন। জিজ্ঞাসাবাদের সময় এই ঘাতক জানিয়েছিলেন, ‘সুজানগর অপারেশনের আগের দিন পাথরতলায় আবদুস সুবহানের বাসায় মিটিং হয়েছিল এবং মিটিংয়ে সুজানগর অপারেশনের পরিকল্পনা নেওয়া হয়।’ পাবনার যে কোনো অপারেশনের আগে মাওলানা সুবহানের বাসায় পরিকল্পনা করা হতো বলে জহিরুল ইসলাম বিশু গণতদন্ত কমিশনকে জানান। অভিযোগ রয়েছে, বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে পাবনায় জামায়াতের দখলদারিত্ব ও লুটপাটের রাজত্ব চলে। ক্ষমতার অপব্যবহার করে শহরে ৫ কোটি টাকার ৩ একর জায়গা মাত্র ৭৪ লাখ টাকায় জামায়াতকে দেওয়া হয়। সেখানে ইমাম গাযযালী স্কুল অ্যান্ড কলেজ নামে জামায়াতের একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয়। এছাড়া জামায়াত ক্যাডাররা পাবনায় বাংলা চলচ্চিত্রের কিংবদন্তি অভিনেত্রী সুচিত্রা সেনের পৈতৃকবাড়ি দখল করে ইমাম গাযযালী ইনস্টিটিউট গড়ে তোলে। তবে জামায়াত নেতাদের দাবি, তারা বাড়িটি লিজ নিয়ে সেখানে গাযযালী ইনস্টিটিউট করেছেন।

দৈনিক সমকাল, ১৮ ডিসেম্বর, ২০০৮

২০ ডিসেম্বর, ২০০৮

নির্বাচনে যুদ্ধাপরাধী প্রার্থীরা- ০৭

প্রিন্সিপাল রুহুল কুদ্দুস

সমকাল প্রতিবেদক

কয়রা ও পাইকগাছা উপজেলার একাংশ নিয়ে গঠিত খুলনা-৬ আসন থেকে চারদলীয় জোটের প্রার্থী হয়েছেন প্রিন্সিপাল শাহ মোহাম্মদ রুহুল কুদ্দুস। একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধে তিনি ছিলেন কেন্দ্রীয় শান্তি কমিটির তেইশ নম্বর সদস্য। রাজাকার বাহিনীর কেন্দ্রীয় সংগঠকও ছিলেন তিনি। জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ ও সংসদীয় দলের সদস্যসচিব রুহুল কুদ্দুসের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের নানা অভিযোগ রয়েছে। মুক্তিযুদ্ধকালে কুখ্যাত রাজাকার হিসেবেই পরিচিত ছিলেন তিনি।

মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর প্রকাশিত ‘৭১ : গণহত্যার দলিল’ ও ‘মুক্তিযুদ্ধে ব্যক্তির অবস্থান’ গ্রন্থে এবং ওয়ার ক্রাইমস ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটির কাছে সংরক্ষিত মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন দলিল-দস্তাবেজ থেকে জানা গেছে, শাহ মোহাম্মদ রুহুল কুদ্দুস মুক্তিযুদ্ধের সময় পরিচিত ছিলেন ‘প্রিন্সিপাল রুহুল কুদ্দুস’ নামে। তার বাবা কয়রা উপজেলার আমাদী গ্রামের মরহুম শাহ মকবুল হোসেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় ১৯৬৩ সালে রুহুল কুদ্দুস ছিলেন নিখিল পাকিস্তান ছাত্রসংঘের সাধারণ সম্পাদক। লেখাপড়া শেষে বাগেরহাটের রামপালের একটি কলেজে অধ্যক্ষ হিসেবে চাকরি শুরু করেন। ১৯৭১ সালে বাগেরহাটের একটি কলেজে তিনি শিক্ষকতা করতেন। ওই কলেজে শিক্ষকতার সময় রাজাকার বাহিনীর নেতা হিসেবে বাগেরহাটে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী কর্মকাণ্ডে অংশ নেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তিনি আর নিজ এলাকায় ফিরে না এসে আত্মগোপনে চলে যান। ’৭৫-এর ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যার পর পটপরিবর্তনের পথ ধরে এলাকায় ফিরে আসেন তিনি। যুক্ত হন জামায়াতের রাজনীতির সঙ্গে। সাংগঠনিক দক্ষতার কারণে অল্পদিনেই জামায়াতের শীর্ষস্থানীয় নেতা বনে যান তিনি।

মুক্তযুদ্ধকালে ৯ নম্বর সেক্টরের আঞ্চলিক কমান্ডার ও খুলনার মুক্তিযোদ্ধা অ্যাডভোকেট স ম বাবর আলী বলেন, ‘ঢাকায় মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর ইংরেজিতে একটি বই প্রকাশ করে। তাতে উল্লেখ রয়েছে, একাত্তরে তিনি আলবদর বাহিনীর নেতা ছিলেন। পাক হানাদার বাহিনীর দোসর হিসেবে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মানুষের ওপর বিভিন্ন অত্যাচার চালান তিনি।’

স্থানীয় বীর মুক্তিযোদ্ধা জিএম মতিউর রহমান জানিয়েছেন, একাত্তরের পাকসেনাদের সহায়তা, নারী ধর্ষণ ও লুটতরাজের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত ছিলেন প্রিন্সিপাল হাবিবুর রহমান।

’৯১ সালে জাতীয় রাজনীতিতে সরাসরি সম্পৃক্ত হন শাহ মোহাম্মদ রুহুল কুদ্দুস। সে বছর জামায়াত থেকে মনোনয়ন নিয়ে খুলনা-৬ আসনের সাংসদ নির্বাচিত হন। কিন্তু টানা পাঁচ বছর এলাকার উন্নয়নে কোনো কাজ না করায় তীব্র ইমেজ সংকট দেখা দেয় তার। পরাজিত হন ’৯৬ সালের নির্বাচনে। ২০০১ সালের সংসদ নির্বাচনে চারদলীয় জোটের প্রার্থী হিসেবে তৃতীয় দফায় সাংসদ নির্বাচিত হন। সেই থেকে বদলে যেতে থাকে তার পরিবারের ভাগ্যলিপি। বাবার ক্ষমতার দাপটে ছেলে শাহ জুবায়ের হোসেন নিয়ন্ত্রণকর্তা বনে যান সুন্দরবনের পাইকগাছা ও কয়রা উপজেলা অংশের। মাত্র পাঁচ বছরে মালিক হন কোটি কোটি টাকার। বর্তমানে কয়রা ও পাইকগাছার জামায়াতের দুটি সিন্ডিকেটের সমন্বয়ক রুহুল কুদ্দুসের বড় ছেলে শাহ জুবায়ের।

ধর্মের কথা বলে রাজনীতি করলেও এ সাংসদের আদরের পুত্র শাহ জুবায়ের কেবল মাদ্রাসা শিক্ষায় শিক্ষিত। ধর্মের ন্যূনতম অনুশাসন মেনে চলেন না তারা কেউই। দুই বছর আগে খুলনায় এক প্রতিবেশী মহিলাকে মাথা ন্যাড়া করে বৈদ্যুতিক খুঁটির সঙ্গে বেঁধে রেখে অসহনীয় নির্যাতনের সেই চিত্র এখনো ভীতির সঞ্চার করে এলাকাবাসীর মধ্যে। তখন এ ঘটনা জাতীয় পর্যায়েও ব্যাপক সমালোচনার ঝড় তোলে।

এলাকার বাসিন্দারা অভিযোগ করেছেন, বাবা সাংসদ হওয়ার পর থেকে সুন্দরবনের কাঠ ও গোলপাতা চুরির একাধিক সিন্ডিকেট গড়ে তোলেন জুবায়ের। আয় করতে থাকেন বিপুল অর্থ। কয়রায় ৬-৭টি ঘের দখল করে ব্যবসা করছেন। বিগত পাঁচ বছর জামায়াতের প্রভাব খাটিয়ে দুটি উপজেলার সরকারি বরাদ্দ থেকে আদায় করেছেন মোটা অঙ্কর কমিশন।

এত বিত্ত-বৈভবের মালিক হলেও পৈতৃক বাড়িতে নামমাত্র একটি টিনের ঘর তুলেছেন রুহুল কুদ্দুস। তিনি থাকেন খুলনায় নিরাশী আবাসিক এলাকার একটি ভাড়া বাড়িতে। ঘনিষ্ঠজনরা বলছেন, রুহুল কুদ্দুস ঢাকায় একটি বাড়ি কিনেছেন। আর পুত্র শাহ জুবায়ের পাইকগাছা উপজেলার জামায়াত নেতা গাজী তানজিদ আলম, মাওলানা আবুল কাশেম, মাওলানা আবদুল মজিদ ও চাচার মেয়ে জামাই মোস্তাফিজুর রহমানকে সঙ্গে নিয়ে নিয়ন্ত্রণ করছেন এ উপজেলার টেন্ডারবাজি, পুলিশের দালালিসহ সব প্রশাসনিক কর্মকাণ্ড। আর কয়রা উপজেলায় এসব বিষয় দেখভাল করছেন সাংসদ বাবার মদদপুষ্ট জামায়াত নেতা সোহরাব হোসেন, মোহাম্মদ ওলিউলল্লাহ, ডা. জিন্নাহ ও মাওলানা শামসুজ্জামান।

২০০১ সালে জোট সরকার ক্ষমতায় আসার কিছুদিন পর কয়রায় রুহুল কুদ্দুসের অনুসারী কয়েকজন জামায়াত নেতা দেশের প্রচলিত আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে ‘আদালত’ বসিয়ে বিচার কার্যক্রম শুরু করেন। ওই সময় এ ব্যাপারে একাধিক সংবাদ প্রকাশিত হলে জামায়াতের নেতা-কর্মীরা আদালতটি বন্ধ করে দেয়।

পাইকগাছা উপজেলা বিএনপির সভাপতি জিএ সবুর ধর্মের অনুশাসন না মানার অভিযোগ তুলে বলেন, ‘পারিবারিকভাবেই যিনি ইসলাম প্রতিষ্ঠায় উদ্যোগী নন, তিনি কী করে দেশে ইসলামী শাসন প্রতিষ্ঠা করবেন?’ তিনি আরো বলেন, ‘এই জামায়াত নেতা নিজের ভাগ্যের উন্নয়ন ঘটাতেই সাংসদ হয়েছেন, নির্বাচনে দাঁড়িয়েছেন।’ এমনকি রুহুল কুদ্দুসের আত্মীয়স্বজনরাও ক্ষিপ্ত এ পরিবারের ওপর। রুহুল কুদ্দুসের আপন চাচাত ভাই কয়রার আমাদী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান শাহ ইবাদত আলী বলেন, ‘জনগণের উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি দিয়েই ক্ষমতাসীন হয়ে যারা তাদের সম্পদ লুটে খায় তারা অবশ্যই আল্লাহর বিরোধী। শাহ রুহুল কুদ্দুস তাদেরই একজন।’ আর সাবেক সাংসদ জেলা অওয়ামী লীগ নেতা নুরুল হক বলেন, ‘আল্লাহর আইন আর সৎ লোকের শাসন প্রতিষ্ঠার নামে জনগণের ভোট নিয়ে শাহ রুহুল কুদ্দুস নিজেকে সমাজে একজন ধনী ব্যক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করছেন।’

দৈনিক সমকাল, ১৮ ডিসেম্বর, ২০০৮

নির্বাচনে যুদ্ধাপরাধী প্রার্থীরা- ০৬

মুহাম্মদ কামারুজ্জামান

শেরপুর প্রতিনিধি

জামায়াত নেতা মুহাম্মদ কামারুজ্জামান এবারো ভোটপ্রার্থী। পরপর ৪ বার শেরপুরের মানুষ তাকে প্রত্যাখ্যান করলেও হাল না ছেড়ে শেরপুর-১ (সদর) আসনে ফের তিনি চারদলীয় জোটের প্রার্থী হয়েছেন। এ আসনে তার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী শেরপুরের কনিষ্ঠ মুক্তিযোদ্ধা সাবেক এমপি মহাজোট প্রার্থী জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি আতিউর রহমান আতিক। অভিযোগ রয়েছে, কামারুজ্জামান মুক্তিযুদ্ধের সময় আলবদর বাহিনীর সংগঠক ছিলেন। যুদ্ধাপরাধী ও স্বাধীনতাবিরোধী হিসেবে তার বিরুদ্ধে রয়েছে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ।

শেরপুর সদর উপজেলার বাজিতখিলা ইউনিয়নের মুদিপাড়ার বাসিন্দা কৃষক পরিবারের সন্তান মুহাম্মদ কামারুজ্জামান ৫ ভাই ও ৩ বোনের মধ্যে তৃতীয়। কামারুজ্জামান এবং তার আলবদর বাহিনী ১৯৭১ সালে শেরপুরসহ বৃহত্তর ময়মনসিংহে স্বাধীনতাকামী বাঙালিদের হত্যা, নির্যাতন ও সম্পদ লুণ্ঠনসহ ঘৃণ্যতম অপরাধ সংঘটিত করেন বলে অভিযোগ রয়েছে। ইতিহাসবিদ ড. মুনতাসীর মামুন সম্পাদিত ‘মুক্তিযুদ্ধ কোষ’ গ্রন্থে উল্লেখ করা হয়েছে- ‘দেশে হাতেগোনা ১০ কুখ্যাত নরঘাতকের মধ্যে এই কামারুজ্জামান একজন।’
বর্তমানে তিনি সাপ্তাহিক সোনার বাংলার সম্পাদক এবং বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় সিনিয়র সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল।

একাত্তরের ঘাতক-দালাল ও যুদ্ধাপরাধীদের সম্পর্কে গঠিত জাতীয় গণতদন্ত কমিশনের রিপোর্টে বলা হয়েছে, ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় কামারুজ্জামানের স্বাধীনতাবিরোধী তৎপরতা এবং যুদ্ধাপরাধের বিবরণ তৎকালীন সংবাদপত্র, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিষয়ক গ্রন্থ ও নির্যাতিত ব্যক্তিদের কাছ থেকে জানা গেছে। ১৯৭১ সালে কামারুজ্জামান জামায়াতে ইসলামীর তৎকালীন ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘের ময়মনসিংহ জেলার নেতা ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় জামালপুরে প্রথম আলবদর বাহিনী গড়ে ওঠে, যার প্রধান সংগঠক ছিলেন তিনি।

১৯৭১ সালের ১৬ আগস্ট দৈনিক সংগ্রামে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘পাকিস্তানের ২৩তম আজাদী দিবস উপলক্ষে গত শনিবার মোমেনশাহী আলবদর বাহিনীর উদ্যোগে মিছিল ও সিম্পোজিয়াম অনুষ্ঠিত হয়। স্থানীয় মুসলিম ইনস্টিটিউটে আয়োজিত ওই সিম্পোজিয়ামে সভাপতিত্ব করেন আলবদর বাহিনীর প্রধান সংগঠক কামারুজ্জামান।

নৃশংসতার নমুনা : পরীক্ষা শেষে শেরপুর কলেজের ছাত্র গোলাম মোস্তফাকে ১৯৭১ সালের ২৪ আগস্ট কামারুজ্জামানের আলবদর বাহিনী রাস্তা থেকে ধরে নিয়ে যায় শহরের সুরেন্দ্র মোহন সাহার বাড়িতে। এই বাড়িটিকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী দখল করে টর্চার ক্যাম্প বানিয়েছিল। সেই ক্যাম্পে গোলাম মোস্তফাকে শারীরিক নির্যাতনের পর রাত ৮টার দিকে শহরের দক্ষিণ প্রান্তে শেরীব্রিজ এলাকায় নিয়ে গুলি করে আলবদররা নৃশংসভাবে হত্যা করে। এমন অভিযোগ করেন শহীদ গোলাম মোস্তফার ছোট ভাই মোশাররফ হোসেন তালুকদার। কামারুজ্জামানের নির্দেশে জি কে স্কুলের ছাত্র ফুটবল খেলোয়াড় কাজল এবং কায়সারকে হত্যা করা হয়।

গণতদন্ত কমিশনের রিপোর্ট অনুসারে, নালিতাবাড়ি উপজেলার বদিউজ্জামানকে মুক্তিযুদ্ধের সময় কামারুজ্জামানের নেতৃত্বে ১১ জনের একটি দল ধরে নিয়ে ঝিনাইগাতীর আহমদনগর পাকিস্তানি বাহিনীর ক্যাম্পে হত্যা করে। এ তথ্য জানিয়েছেন শহীদ বদিউজ্জামানের পিতা ফজলুল হক।

১৯৭১ সালের মে মাসের মাঝামাঝি শেরপুরের জনপ্রিয় শিক্ষক অধ্যক্ষ সৈয়দ আবদুল হান্নানকে মুখে চুনকালি মেখে, গলায় জুতার মালা পরিয়ে, অর্ধউলঙ্গ অবস্থায় কামারুজ্জামানের দলবল শহরের রাস্তায় রাস্তায় ঘুরিয়ে চরমভাবে অসম্মানিত ও অপদস্ত করে।

সম্প্রতি ওয়ার ক্রাইম ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটি এবং মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম ঘোষিত শীর্ষ ৫০ যুদ্ধাপরাধীর তালিকায় ৩ নম্বরে রয়েছে কামারুজ্জামানের নাম। গত ১২ নভেম্বর শেরপুরে সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম/মুক্তিযোদ্ধা ’৭১-এর মতবিনিময় সভায় জেলার ১২ জন যুদ্ধাপরাধীর নাম ঘোষণা করা হয়। এতে জামায়াত নেতা কামারুজ্জামানের নাম ছিল শীর্ষস্থানে।

এদিকে, ঢাকার কেরানীগঞ্জের মুক্তিযোদ্ধা মোজাফ্ফর আহমেদ খান বাদী হয়ে ২০০৭ সালের ১৭ ডিসেম্বর মুখ্য মহানগর আদালতে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে তার এক নিকটাত্মীয়কে হত্যার অপরাধে নিজামী ও মুজাহিদসহ ১৩ জনের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা দায়ের করেন। কামারুজ্জামান সেই মামলারও আসামি।
আত্মস্বীকৃত আলবদর এবং শেরপুর শহরের সুরেন্দ্র মোহন সাহার বাসায় মুক্তিযুদ্ধকালে পাকিস্তানি বাহিনীর টর্চার ক্যাম্পের পাহারাদার মোহন মিয়া জানান, কামারুজ্জামানের নির্দেশে প্রতিনিয়তই সেখানে নিরীহ মানুষকে ধরে নিয়ে নানাভাবে নির্যাতন চালানো হতো। কাউকে কাউকে নির্যাতন শেষে হত্যা করা হতো।
মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক শিক্ষাবিদ মহসীন আলী জানান, মুক্তিযুদ্ধের ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং কমিটির অনুসন্ধানে কামারুজ্জামান শেরপুর অঞ্চলে যুদ্ধাপরাধের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল। অবশ্যই তার বিচার হওয়া উচিত। মুক্তিযুদ্ধের ছাত্র সংগঠক আমজাদ হোসেন জানান, আলবদর কামরানের কথা বলে কামারুজ্জামানের অপকর্ম ঢাকার অপচেষ্টা চালানো হয়। এজন্য তার ফাঁসি চাই।

এ ব্যাপারে একাধিকবার সাংবাদিকদের কাছে দেওয়া সাক্ষাৎকারে জামায়াত নেতা কামারুজ্জামান জানান, একাত্তরে তিনি শেরপুরেই ছিলেন না। তবে কোথায় ছিলেন, এ ব্যাপারেও স্পষ্ট করে কিছু বলেননি। তার মতে, একাত্তরে আলবদর বাহিনীর ঘাতক কামরানের সঙ্গে তার নামটিকে ভুলভাবে এক করে ফেলা হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে একাত্তরের ঘটনাবলির সঙ্গে তিনি জড়িত ছিলেন না।

গণতদন্ত কমিশনের রিপোর্ট : মুহাম্মদ কামারুজ্জামান সম্পর্কে একাত্তরের ঘাতক দালাল ও যুদ্ধাপরাধীদের সম্পর্কে জাতীয় গণতদন্ত কমিশনের রিপোর্টে আরো বলা হয়, ‘১৯৭১ সালের ১৬ আগস্ট দৈনিক সংগ্রামে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পাকিস্তানের ২৫তম আজাদী দিবস উপলক্ষে গত শনিবার মোমেনশাহী আলবদর বাহিনীর উদ্যোগে মিছিল ও সিম্পোজিয়াম অনুষ্ঠিত হয়। স্থানীয় মুসলিম ইনস্টিটিউটে আয়োজিত এ সিম্পোজিয়ামে সভাপতিত্ব করেন আলবদর বাহিনীর প্রধান সংগঠক কামারুজ্জামান। এক তার বার্তায় প্রকাশ, সিম্পোজিয়ামে বিভিন্ন বক্তা দেশকে ধ্বংস করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত দুশমনদের সম্পর্কে সতর্কবাণী উচ্চারণ করেন।’

শেরপুরের একজন শহীদের পিতা ফজলুল হক গণতদন্ত কমিশনকে জানিয়েছেন, তার ছেলে শহীদ বদিউজ্জামানকে মুক্তিযুদ্ধের সময় আষাঢ় মাসের একদিন তার বেয়াইয়ের বাড়ি থেকে কামারুজ্জামানের নেতৃত্বে ১১ জনের একটি দল ধরে নিয়ে যায়। শহীদ বদিউজ্জামানকে ধরে আহমদনগর পাকিস্তানি বাহিনীর ক্যাম্প নিয়ে গিয়ে হত্যা করা হয়। স্বাধীনতার পর শহীদের বড় ভাই হাসানুজ্জামান বাদী হয়ে নালিতাবাড়ী থানায় মামলা দায়ের করেন। এ মামলায় ১৮ জন আসামির অন্যতম ছিলেন কামারুজ্জামান। মামলাটির নম্বর-২(৫)৭২। জিআর নং-২৫০(২)৭২।

রিপোর্টে বলা হয়, ‘শেরপুর জেলার শহীদ গোলাম মোস্তফার চাচাতো ভাই শাহজাহান তালুকদার জানিয়েছেন, ১৯৭১ সালের ২৪ আগস্ট আলবদররা গোলাম মোস্তফাকে শেরপুর শহরের সড়ক থেকে ধরে বলপূর্বক তাদের ক্যাম্পে নিয়ে যায়। শেরপুর শহরের সুরেন্দ্রমোহন সাহার বাড়িটি দখল করে আলবদররা তাদের ক্যাম্প বানিয়েছিল। সে ক্যাম্পে গোলাম মোস্তফাকে ধরে নিয়ে আলবদররা তার গায়ের মাংস ও রগ কেটে, হাত বেঁধে হাঁটিয়ে নিয়ে যায় শেরী ব্রিজের নিচে। সেখানে তারা গুলি করে হত্যা করে গোলাম মোস্তফাকে। কামারুজ্জামানের প্রত্যক্ষ নির্দেশে এ হত্যাকাণ্ডটি ঘটেছিল। শহীদ গোলাম মোস্তফার হত্যাকাণ্ড যে কামারুজ্জামানের দ্বারা সংঘটিত হয়েছিল এ তথ্য শেরপুরের আরো অনেকেই দিয়েছেন।’

দৈনিক সমকাল, ১৮ ডিসেম্বর, ২০০৮

জনপ্রিয় পোস্টসমূহ