
মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিকাশ কেন্দ্র থেকে ১৯৮৭ সালে প্রকাশিত 'একাত্তরের ঘাতক ও দালালরা কে কোথায়' শীর্ষক বইয়ের ১১১-১১২ নম্বর পৃষ্ঠা থেকে বদর বাহিনীর সঙ্গে কামারুজ্জামানের সম্পৃক্ততার তথ্য জানা যায়। সেখানে বলা হয়, 'জামালপুরে স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী হিসেবে আলবদর বাহিনী গড়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে জামায়াত নেতৃত্ব হৃদয়ঙ্গম করতে পারে যে ছাত্রসংঘকে তারা সশস্ত্র করে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী সাধারণ তৎপরতা চালানো ছাড়াও বুদ্ধিজীবী হত্যার জন্য বিশেষ স্কোয়াড হিসেবে ব্যবহার করতে পারবে। প্রথমত, পরীক্ষামূলকভাবে সারা ময়মনসিংহ জেলার ইসলামী ছাত্রসংঘের কর্মীদের আলবদর বাহিনী হিসেবে সংগঠিত করে সশস্ত্র ট্রেনিং দেওয়া হয়। এই সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডের পরিচালক ছিলেন কামারুজ্জামন এবং তাঁর নেতৃত্বেই ময়মনসিংহ জেলার সকল ছাত্রসংঘকর্মীকে আলবদর বাহিনীর অন্তর্ভুক্ত করা হয়।'
এমনকি তাঁর বিরুদ্ধে শেরপুরের সূর্যদি গণহত্যাকাণ্ড এবং নকলার মুক্তিযোদ্ধা হন্তার বাড়িতে অগি্নসংযোগ ও লুটপাটে পাকিস্তানি সেনাদের সহযোগিতার অভিযোগ রয়েছে।

গণতদন্ত কমিশনের কাছে শেরপুরের ফজলুল হক তাঁর ছেলে বদিউজ্জামানকে হত্যার জন্য কামারুজ্জামানকে দায়ী করেন। তিনি বলেন, 'মুক্তিযুদ্ধের সময় আষাঢ় মাসের একদিন তাঁর বেয়াইয়ের বাড়ি থেকে তাঁকে কামারুজ্জামানের নেতৃত্বে ১১ জন লোকের একটি দল ধরে নিয়ে যায়। শেরপুরের আহমদনগর থেকে ধরে বদিউজ্জামানকে। পরে ফজলুল হককে ছেড়ে দিলেও বদিউজ্জামানকে আহমদনগর পাকিস্তানি ক্যাম্পে ধরে নিয়ে হত্যা করা হয়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালের ২ মে শহীদের বড় ভাই হাসানুজ্জামান বাদী হয়ে নালিতাবাড়ী থানায় মামলা দায়ের করেন। এই মামলায় ১৮ জন আসামির অন্যতম ছিলেন কামারুজ্জামান। মামলাটির নম্বর ২(৫) ৭২ ও জিআর নম্বর ২৫০ (২) ৭২।'
গণতদন্ত কামশনের কাছে শেরপুর জেলার শহীদ গোলাম মোস্তফার চাচাতো ভাই শাহজাহান তালুকদার জানিয়েছেন, ১৯৭১ সালের ২৪ আগস্ট আলবদররা গোলাম মোস্তফাকে শেরপুর শহরের সড়ক থেকে ধরে জোর করে তাদের ক্যাম্পে নিয়ে যায়। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মানুষ ও মুক্তিযোদ্ধাদের দমন করতে শেরপুর শহরের সুরেন্দ্র মোহন সাহার বাড়িতে তখন আলবদর বাহিনীর একটি ক্যাম্প তৈরি করেছেন কামারুজ্জামান। ক্যাম্পে একটি টর্চার সেলও ছিল। সেখানে নিয়ে গোলাম মোস্তফার গায়ের মাংস ও রগ কেটে দেওয়া হয়। তারপর হাত বেঁধে হাঁটিয়ে নিয়ে শেরী ব্রিজের নিচে কামারুজ্জামানের নির্দেশেই একাত্তরের ২৪ জানুয়ারি নৃশংসভাবে হত্যা করা হয় গোলাম মোস্তফাকে।

বাংলাদেশ ছাত্রলীগ শেরপুর জেলা শাখার সাবেক সভাপতি ও শহীদ পিতার সন্তান তাপস সাহা কমিশনকে জানান, মুক্তিযুদ্ধের সময় কামারুজ্জামান ও তাঁর সহযোগীরা শেরপুরের বিভিন্ন এলাকা থেকে বাঙালি নারী-পুরুষকে আলবদর ক্যাম্পে ধরে নিয়ে যেত। সেখানে তারা চাবুক দিয়ে পেটাত। কামারুজ্জামানের বাহিনী শেরপুর পৌরসভার সাবেক কমিশনার মজিদকে ধরে নিয়ে গিয়েছিলে সেই টর্চার ক্যাম্পে। সকালে ধরে নিয়ে পুরো দিন তাঁকে টর্চার ক্যাম্পের 'অন্ধকার কূপ'-এ আটকে রাখে। একইভাবে মে মাসের মাঝামাঝি এক দুপুরে তারা শেরপুর কলেজের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের প্রভাষক সৈয়দ আবদুল হান্নানকে খালি গায়ে, মাথা ন্যাড়া করে, গায়ে-মুখে চুনকালি মাখিয়ে, গলায় জুতার মালা পরিয়ে উলঙ্গ অবস্থায় চাবুক দিয়ে পেটাতে পেটাতে কামারুজ্জামান ও তাঁর সহযোগীরা শেরপুর শহর প্রদক্ষিণ করে।
পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কিলিং স্কোয়াড 'আলবদর'-এর মুক্তিযুদ্ধকালীন মানবতাবিরোধী অপরাধ ও গণহত্যার চাঞ্চল্যকর সব তথ্য নিয়ে নির্মিত 'আলবদর : এ কিলিং স্কোয়াড অব পাকিস্তান আর্মি, ১৯৭১' নামের প্রামাণ্যচিত্রে কামারুজ্জামানের যুদ্ধাপরাধ উঠে এসেছে।
সেখানে বলা হয়েছে, জামালপুরে কুখ্যাত আলবদর বাহিনীর যে সাতটি ক্যাম্প ছিল, তার মধ্যে শেরপুরের সুরেন্দ্র মোহন সাহার বাড়ির ক্যাম্পটি ছিল সবচেয়ে বিভীষিকাময়। ক্যাম্পটির তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন কামারুজ্জামান। অন্তত ৮০-৯০ জন মুক্তিযোদ্ধা ও নিরীহ বাঙালিকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে এই ক্যাম্পেই। দিনের পর দিন ক্যাম্পের অন্ধকার কুঠুরিতে আটকে রেখে চালানো হয়েছে অসহ্য নির্যাতন। এসব নির্যাতন আর হত্যাকাণ্ডে প্রত্যক্ষ সহযোগী ছিলেন আলবদর বাহিনীর জামালপুর সাবডিভিশনের প্রধান আবদুল বারী এবং সদস্য নাসির ও কামরান।
মুক্তিযুদ্ধের টানা সাত মাস সুরেন্দ্র মোহন সাহার ক্যাম্পের ফটকরক্ষক ছিলেন আলবদর সদস্য মোহন মুন্সী। খুব কাছ থেকে দেখেছেন নির্মম নির্যাতন ও হত্যাযজ্ঞ।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর আশরাফের সহযোগী আবদুল বারীর একটি ডায়েরি পাওয়া যায়। সেখানে মুক্তিযোদ্ধাদের হত্যা, বন্দি ও হিন্দু মেয়েদের ধর্ষণের সুস্পষ্ট প্রমাণ রয়েছে। এই আশরাফেরই অন্য সহযোগী ছিলেন কামারুজ্জামান। ডায়েরিতে কামারুজ্জামানের নির্দেশেই যে টর্চার ক্যাম্পে বন্দি গোলাম মোস্তফা তালুকদারকে গুলি করে হত্যা করা হয়, তার সুস্পষ্ট প্রমাণ রয়েছে।
__
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন