১৯ ডিসেম্বর, ২০০৮

নির্বাচনে যুদ্ধাপরাধী প্রার্থীরা -০২

এ এম রিয়াছাত আলী

সমকাল প্রতিবেদক

আশাশুনি ও শ্যামনগর উপজেলা নিয়ে গঠিত সাতক্ষীরা-৩ আসন থেকে চারদলীয় জোট প্রার্থী হয়েছেন জামায়াত নেতা এএম রিয়াছাত আলী। তার বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ রয়েছে। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে তিনি ছিলেন সাতক্ষীরার আশাশুনি উপজেলার শান্তি কমিটির সেক্রটারি। রাজাকার হিসেবে পরিচিত এই জামায়াত নেতার বিরুদ্ধে একাত্তরে শ্যামনগর ও কালীগঞ্জ থানায় মুক্তিযোদ্ধাদের নির্বিচারে হত্যার অভিযোগ রয়েছে। নিহত এই মুক্তিযোদ্ধাদের একজন হলেন কালীগঞ্জের ইউনুস।

আশাশুনি ও শ্যামনগরের বাসিন্দারা জানান, একাত্তরের আগস্ট মাসে খুলনার কয়রা উপজেলার খুকরোঘাটি লঞ্চঘাটে মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে ধরা পড়েছিলেন স্থানীয় রাজাকার কমান্ডার রিয়াছাত। সেখান থেকে তাকে নেওয়া হয় কয়রার মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে। ক্যাম্পের দায়িত্বে ছিলেন তারই প্রতিবেশী বীর মুক্তিযোদ্ধা মতিয়ার রহমান। তখন রমজান মাস। মতিয়ারের মহানুভবতায় প্রাণভিক্ষা পান রিয়াছাত। নিরাপদে তাকে পৌঁছে দেওয়া হয় আশাশুনি উপজেলার প্রতাপনগর গ্রামের নিজ বাড়িতে। কিন্তু স্বাধীনতার ৩১ বছর পর আবারো পুরনো দিনে ফিরে যান রিয়াছাত আলী বিশ্বাস। অভিযোগ রয়েছে, একদিন যে মুক্তিযোদ্ধা তাকে প্রাণে বাঁচিয়েছিলেন, ২০০১ সালে সেই মতিয়ার রহমানের বাড়িতেই অগ্নিসংযোগ করেন তিনি।

যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ থাকলেও রাজনীতিতে রিয়াছাত আলী বিশ্বাস এখন বেশ শক্তিশালী। তাই এবারো তিনি চারদলীয় জোট থেকে মনোনয়ন পেয়েছেন। একই আসন থেকে পরপর দু’বার সাংসদ নির্বাচিতও হন তিনি। এর আগে একবার মেম্বার ও একবার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছিলেন। তার বাবা সাতক্ষীরার আশাশুনির কুড়িকাহনিয়া গ্রামের মৃত আলী বিশ্বাস পেশায় ছিলেন দর্জি।

রিয়াছাত আলী বিশ্বাসের জন্ম সাতক্ষীরার আশাশুনি উপজেলার প্রতাপনগর গ্রামে। একাত্তরের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে সাতক্ষীরা জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড কাউন্সিলের সাবেক আহ্বায়ক মতিয়ার রহমান জানান, নদী পথে এ অঞ্চলের মানুষের নিয়মিত যোগাযোগ ছিল খুলনা শহরের সঙ্গে। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পরপরই রিয়াছাত আলী বিশ্বাসের নেতৃত্বে গঠিত হয় শান্তি কমিটি। যুদ্ধ চলাকালে খুলনার পাকিস্তান সেনা ক্যাম্পের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করতেন রিয়াছাত। ’৭১-এর জুনে মেজর জলিলের লঞ্চডুবি হয় সুন্দরবন সংলগ্ন গাবুরা এলাকার খোলপেটুয়া নদীতে। কোনোভাবে নদী সাঁতরে প্রতাপনগর গ্রামে চলে আসেন ওই লঞ্চে থাকা বরিশাল অঞ্চলের নয় মুক্তিযোদ্ধা। কিন্তু রক্ষা পান না। খবর পেয়ে প্রতাপনগর ঘিরে ফেলে রাজাকার রিয়াছাত আলী ও তার লোকজন। নয় মুক্তিযোদ্ধাকে ধরে নিয়ে যান খুলনার পাকসেনা ক্যাম্পে। এরপর ওই নয় মুক্তিযোদ্ধার আর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি।

মুক্তিযোদ্ধা মতিয়ার রহমান আরো জানান, রিয়াছাত আলীর সহযোগিতায় একাত্তরের জুলাই মাসে পাঞ্জাব রেজিমেন্টের পাকসেনারা গানবোটে চড়ে প্রতাপনগর গ্রামে হানা দেয়। তারা ওই গ্রামের খগেন্দ্র নাথ সরকারকে খুলনার ক্যাম্পে নিয়ে গুলি করে হত্যা করে। এর কিছুদিন পর একই গ্রামের সোহরাব ও জনাব আলীকে একইভাবে ধরে নিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয় পাকিস্তানি সেনাক্যাম্পে। এ ছাড়া মুক্তিযুদ্ধের পুরো সময় খুলনা, বরিশাল, পটুয়াখালী ও বাগেরহাট এলাকার ভারতগামী শরণার্থীদের নৌকা আটকে লুটপাট করা ছিল রিয়াছাত আলী ও তার লোকজনের কাজ।

’৯১ সালে রিয়াছাত আলী বিশ্বাস প্রথম সাতক্ষীরা-৩ আসন থেকে জামায়াতের টিকিটে সাংসদ নির্বাচিত হন। ’৯৬ সালের নির্বাচনে পরাজিত হন আওয়ামী লীগ প্রার্থীর কাছে। তবে ২০০১-এর নির্বাচনে তিনি একই আসন থেকে আবার সাংসদ নির্বাচিত হন। নির্বাচিত হওয়ার মাত্র কয়েকদিনের মাথায় তারই ইন্ধনে জামায়াতের ক্যাডার বাহিনী মুক্তিযোদ্ধা মতিয়ার রহমানের বাড়ি লুটপাটের পর আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেয় বলে অভিযোগ রয়েছে। পরিবার-পরিজন নিয়ে পালিয়ে না গেলে সেদিন সপরিবারে প্রাণ হারাতেন মুক্তিযোদ্ধা মতিয়ার রহমান। আরো অভিযোগ রয়েছে, গত জোট সরকারের আমলে রিয়াছাত আলীর পরিবারের সদস্যরা যেন বেপরোয়া হয়ে ওঠে। ২০০১ সালের নির্বাচনের পর রাতারাতি দখল করে নেন মুক্তিযোদ্ধা মতিয়ার রহমানের দুটিসহ আওয়ামী সমর্থকদের কয়েকটি চিংড়ি ঘের। তিনি সাতক্ষীরা ও পাটকেলখাটায় নির্মাণ করেছেন বাড়ি। বড় ছেলে জুলফিকার হোসেন মাদ্রাসায় শিক্ষকতার পাশাপাশি ঘের ব্যবসা দেখাশোনা করছেন। মেজো ছেলে নুরুল আফছার সাতক্ষীরার বড় ব্যবসায়ী। রয়েছে একটি কম্পিউটার সার্ভিসিং সেন্টার ও আরএসও নামে একটি এনজিও। বড় ছেলের সরকারি খাল দখলের বিষয়টি আশাশুনিতে ব্যাপক সমালোচনার ঝড় তোলে। ১৯ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত আশাশুনি হাসপাতালের কাজের দরপত্রের স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন বিএনপি নেতা বরুন কুমার বিশ্বাস। রিয়াছাত আলী অবশ্য এসব অস্বীকার করে বলেন, ‘স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় আমি রাজাকার বাহিনীতে যোগ দেইনি। পাকসেনাদের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক ছিল না। নানাজনের কানকথা শুনে মুক্তিযোদ্ধারা তাদের ক্যাম্পে ডেকে নিয়ে গিয়েছিল। পরে ছেড়ে দেওয়া হয়। এমপি হওয়ার পর কোনো অন্যায় কাজ করিনি। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষরা আমাকে রাজাকার বানানোর চেষ্টা করছেন।

দৈনিক সমকাল, ১৮ ডিসেম্বর, ২০০৮

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

জনপ্রিয় পোস্টসমূহ