১২ এপ্রিল
“করাচি বিমান বন্দরে আটককৃত শেখ মুজিব” ক্যাপশনে চারকলাম সমান জায়গা জুড়ে একটি ছবি এ দিন ছাপা হয়। স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় এ দেশের জনগন শেখমুজিবকে মুক্ত অবস্থায় দেখতে চেয়েছিল। এর নিরিখে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র তখন স্টপ গ্যাপে সর্বক্ষণ প্রচার করতো, “শেখমুজিব আমাদের মাঝে আছেন এবং থাকবেন।” কিন্তু এইদিনের দৈনিক সংবাদের খবরে দেশের দৃশ্যপট পাল্টে যায়। জনরোষ বেড়ে যায় কয়েকগুন। দৈনিক সংগ্রাম চেয়েছিল পাঁচপোড়ন নিউজ করে বাংলাদেশীদের মনোবল ভাঙতে, কিন্তু মনের বলতো ভাঙ্গেইনি বরং বেড়েছিলো কুন্ডলাগ্নির মতো।
একই দিন চতুর্থ পাতায় অস্ত্রসহ দুই যুবকের ছবি ছাপা হয় এবং সংবাদে লিখা হয়, “গত শনিবার যশোহরের বেনাপোল সীমান্তে দুই ভারতীয় সীমান্তরক্ষী গ্রেফতার”। কিন্তু ছবির দুই যুবকের ছবি ছিলো অস্পষ্ট। এরা দুজন যে আটককৃত মুক্তিযোদ্ধা ছিলো তাতে কোন সন্দেহ নেই। যেহেতু তারা এদেশের সন্তান তাই তাদেরকে কেউ চিনে ফেলবে এই ভয়ে ছবি অস্পষ্ট করে ফেলা হয়।
এদিন পত্রিকার এডিটোরিয়ালে গোলাম আযমের একটি বেতার ভাষন খুব গুরুত্ব সহকারে প্রকাশ করা হয়। যার সারমর্ম হচ্ছে “ ভারত পূর্ব পাকিস্তানে অনুট্রবেশ ঘটিয়ে মূলত পাকিস্তানের সামনে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে। পূর্ব পাকিস্তানের নিরীহ জনগনকে পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর সামনে পাঠিয়ে পূর্ব পাকিস্তানকে দাসে পরিণত করতে চায়।
“অর্থনৈতিক পূনর্গঠন” শিরোনামে সম্পাদকীয়তে লেখা হয়, গতমাসের সকল হিংসাত্মক, ধ্বংসাত্মক হানাহানিতে নিরাপত্তাহীণতায় ভুগে যারা শহর ত্যাগ করেছিলো তারা আবার শহরে ফিরে আসতে শুরু করেছে। এমনকি যারা প্রদেশ ছেড়ে চলে গিয়েছিলো তারা আবার প্রদেশে ফিরে আসছে। এতে করে বুঝা যায় পূর্ব পাকিস্তানে পরিপূর্ণ শান্তি বিরাজ করছে এবং পাকিস্তান সেনাবাহিনী নিরস্ত্র জনগনের সাথে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে রয়েছে। দেশ এখন শান্তি শৃঙ্খলার দিকে উত্তরণ করছে।
“শান্তি কমিটি গঠন একটি শুভ উদ্যোগ” শিরোণামে একটি বিশেষ প্রবন্ধে লেখা হয়, দেশের শান্তি শৃঙ্খলা পুনঃস্থাপন, ভারতীয় অনুপ্রবেশ ঠেকানো ও পঞ্চমবাহিনীর জঙ্গী তৎপরতা বন্ধে শান্তি কমিটি একটি বিরাট ভূমিকা রাখবে। ঢাকা শহরের মতো দেশের প্রতিটি শহরে এরকম কমিটি গঠন করা হলে পাকিস্তানের সার্ভভৌমত্ব অক্ষুন্ন থাকার ব্যাপারে আর কোন ঝুঁকি থাকবে না।
১৩ এপ্রিল
“পাকিস্তানের প্রতি চীনের দৃঢ় সমর্থন” শিরোণামে পুরো ৮ কলাম জুড়ে বড় বড় হরফে প্রথম পাতায় বিশাল নিউজ করা হয়।
শান্তি কমিটি গঠন করার পর প্রথম মিছিলটি ঢাকায় ১২এপ্রিল বের করা হয়। যার নেতৃত্বে ছিলো ইতিহাসের নিকৃষ্ট কীট গোলাম আযম এবং জনধিকৃত রাজাকার নিজামী। মতিউর রহমান নিজামী তখন ইসলামী ছাত্র সংঘের শীর্ষনেতা। এই মিছিলের খবর দৈনিক সংগ্রাম ৫কলাম ব্যাপী ছবি সহকারে খুব ফলাও করে ছাপে। মিছিলের শ্লোগান ছিলো , “পাকিস্তান জিন্দাবাদ, কায়েদে আযম জিন্দাবাদ” “পাকিস্তানের উৎস কি- লাইলাহা ইল্লাল্লাহ” “মিথ্যা প্রচার বন্ধ কর” ব্রাক্ষ্মবাদ নিন্দাবাদ, সাম্রায্যবাদ মূর্দাবাদ”। মিছিলের খবরে বিশেষ ভাবে উল্লেখ করা হয়, জিন্নাহ, লিয়াকত আলী খান ও ইয়াহিয়ার বড় বড় ছবি মিছিলে শোভাপায়। শান্তি কমিটির মিছিল শেষে গোলাম আযম যে মোনাযাত করেন তার কভারেজ দিতে গিয়ে লেখা হয়, “পাকিস্তানের সেনাবাহিনীকে দেশ রক্ষার জন্য আরও বেশি শক্তিদানের জন্য গোলাম আযমের নেতৃত্বে হাজার হাজার ধর্মপ্রাণ পাকিস্তানী আল্লাহর দরবারে দোয়া করেন।”
১৪ এপ্রিল
“ফ্যাসিবাদী ভারতের স্বরূপ” শিরোণামে উপসম্পাদকীয়তে লেখা হয়, “জয় বাংলা আন্দোলন বানচাল হয়ে যাওয়ায় দেশে এখন সু’দিন ফিরে এসেছে। এতে করে ফ্যাসিবাদী ভারতের সকল অপপ্রচার নস্যাৎ হয়ে গেছে।”
একই দিন পত্রিকায় জাতিসংঘের ব্যাপক সমালোচনা করা হয়। নিরপরাধ বাংলাদেশীদের জন্য সহমর্মিতা জানাতে গিয়ে জাতিসংঘকে সঙগ্রামের মতো একটি পত্রিকার কট্টুছাগুরাম সম্পাদকের সমালোচনা হজম করতে হয়। ১৯৭১ সালে চীন ছিলো জাতিসংঘ বহির্ভুত একটি কম্যুনিস্ট রাষ্ট্র। দৈনিক সংগ্রাম তীব্র কম্যুনিস্ট বিরোধী হওয়া সত্বেও শুধুমাত্র একাত্তরে পাকিস্তানকে সমর্থন দানের কারণে চীনের শাসন ব্যবস্থার প্রশংসায় গদগদ করেছিলো। “চীনের সমর্থন” শিরোণামে ১৪ এপ্রিল প্রকাশিত সম্পাদকীয়তে পাকিস্তানকে সমর্থন করায় চীনের বাহুল্য প্রশংসা করা হয়। অপরদিকে নিধনযজ্ঞে পাকিস্তানকে সমর্থন না দেওয়ার কারণে জাতিসংঘের ব্যাপক সমালোচনা করা হয়। জাতিসংঘের সমালোচনা করতে গিয়ে লেখা হয়, “ চীন নয় বরং জাতিসংঘেরই উচিত ছিলো পাকিস্তানকে প্রত্যক্ষভাবে সমর্থন করা এবং সামরিকভাবে পাকিস্তানকে সাহায্য করা। জাতিসংঘের এমন দ্বায়িত্বহীন কর্মকান্ডে বিশ্বে এখন অহেতুক বিপ্লবের জন্ম নিবে এবং এত করে ভারতের মতো নব্য সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্র সমূহ সোৎসাহে বিচ্চিন্নতাবাদীদের সাহায্য করে যাবে।"
১৫ এপ্রিল
দৈনিক সংগ্রাম তার প্রতিটি সংবাদে বোঝাতে চাইতো দেশে পূর্ণঙ্গ শান্তি বিরাজ করছে। এবং দেশের চলমান জঙ্গী তৎপরতা খুবই সীমিত। কিন্তু ১৫ এপ্রিল “ঢাকা থেকে রাজশাহী পর্যন্ত বিশাল এলাকা দুষ্কৃতিকারী মুক্ত” শিরোণামেই থলের বিড়ালটি বেরিয়ে আসে। এতে পতীয়মান হয় দেশে মোটেও শান্তি নেই এবং পাকিস্তান সেনাবাহিনী কথিত অশান্তি রোধে ব্যাপক হত্যাকান্ড চালাচ্ছে। নইলে “দুষ্কৃতিকারী মুক্ত” শব্দের উৎপত্তি হয় কিভাবে? ছাগল হারিয়ে বৌকে মা এবং ছেলেকে বাপ ঢাকার মতো অবস্থায় ছিলো দৈনিক সংগ্রাম। কখনও বলতো দেশে পরিপূর্র্ণ শান্তি বিরাজ করছে আবার কখনও বলতো ভারতের ইন্ধনে দেশে বাংলাদেশীরা বিশৃঙ্খলা করে শান্তি বিনষ্ট করছে।
১৫ এপ্রিলেই প্রথম পাকিস্তানের বিমান হামলার কথা স্বীকার করা হয়। খবরে বলা হয় “ এ পর্যন্ত সংগঠিত সকল বিমান আক্রমনের উদ্দেশ্য ছিলো ভারতীয় অনুপ্রবেশ কারীদের রুখার জন্য এবং জঙ্গী দমনে।”
তথ্যসূত্র: সামহোয়ারইনব্লগ
এতে সদস্যতা:
মন্তব্যগুলি পোস্ট করুন (Atom)
জনপ্রিয় পোস্টসমূহ
-
আবদুল কাদের মোল্লা থাকেন রাজধানীর বড় মগবাজারের জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের পাশে গ্রিনভ্যালি অ্যাপার্টমেন্টে। তাঁর বিরুদ্ধে একাত্তর...
-
- একরামুল হক শামীম : শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ১৯৭১ সালে নারীর ওপর যে বীভৎস নির্যাতন চালানো হয়েছিল তা মানব ইতিহাসে বিরল। নারীর প্রতি অত...
-
বিদেশী বন্ধুদের জন্য সম্মানা ক্রেস্ট মুক্তিযুদ্ধে অনন্য অবদান রাখার জন্য বিদেশী বন্ধুদের সম্মাননা দেওয়া হবে। মানুষের চেতনায় লেখা হয়ে যাব...
-
সাধারণত আমরা বিভিন্ন জাতীয় দিবসে বাড়িতে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করি। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে প্রতিদিন জাতীয় পতাকা উত্তোলন করতে হয়। এ বিষয়ে আমাদের কা...
-
আজহারুল ইসলাম রংপুর অফিস মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বাঙালি নিধনে পাক হানাদার বাহিনীর সহায়তায় গঠিত কুখ্যাত রাজাকার-আলবদর বাহিনীর নেতৃস্থানীয়দের অন্য...
-
প্রিন্সিপাল রুহুল কুদ্দুস সমকাল প্রতিবেদক কয়রা ও পাইকগাছা উপজেলার একাংশ নিয়ে গঠিত খুলনা-৬ আসন থেকে চারদলীয় জোটের প্রার্থী হয়েছেন প্রিন্সিপাল...
-
১৯৭১ সালের এই দিনে প্রতিবাদ প্রতিরোধ বিদ্রোহ বিক্ষোভে সুপ্ত আগ্নেয়গিরি ঘুম ভেঙ্গে জেগে উঠেছিল। শেকল ছেঁড়ার অদম্য আকাঙ্ক্ষায় দুরন্ত দুর্বার হ...
-
এ এম রিয়াছাত আলী সমকাল প্রতিবেদক আশাশুনি ও শ্যামনগর উপজেলা নিয়ে গঠিত সাতক্ষীরা-৩ আসন থেকে চারদলীয় জোট প্রার্থী হয়েছেন জামায়াত নেতা এএম রিয়াছ...
-
শান্তি কমিটি গঠনের সূত্রপাত। টিক্কা খানের সাথে বৈঠকরত ১২ জন রাজনৈতিক নেতার সমন্বয়ে গঠিত প্রতিনিধি দলের নেতা নুরুল আমিন ও গোলাম আযম। দৈনিক পূ...
-
আজ ৯ মার্চ। ১৯৭১-এর উত্তাল-অগ্নিগর্ভ দিনগুলোর একটি। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের পর থেকে দেশ তাঁর নির্দেশনা অনুযায়ী চলতে থাকে। এই দিনে মিছিলে...
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন