৮ আগস্ট, ২০০৮

এক মুক্তিযোদ্ধা নারীর সাক্ষাৎকার

মুক্তিযোদ্ধা গবেষণা কেন্দ্র কর্তৃক গৃহীত এক মুক্তিযোদ্ধা নারীর সাক্ষাৎকার।

নাম : তারাবান বেওয়া
স্বামী : আলতাফ চৌধুরী (১৯৭১ সালে পাকিস্তানি সৈন্যদের হাতে নিহত)
গ্রাম : প্রাণকৃষ্ণপুর, চরকোনা চরা,
ইউনিয়ন : পুটিমারা,
ডাকঘর : পুটিমারা,
থানা : নবাবগঞ্জ,
জেলা : দিনাজপুর
শিক্ষাগত যোগ্যতা : নিরক্ষর
১৯৭১ সালে বয়স : ৩০
১৯৭১ সালে পেশা : গৃহবধু
বর্তমান পেশা : গৃহিণী


প্র: ১৯৭১ সালে যুদ্ধের ঘটনা কি আপনার মনে পড়ে ?
উ: হ, মনে আছে, দেশে তহন যুদ্ধ লাগছিলো। খানেরা তহন আমাদের দেশের অনেক লোক মারছিলো।

প্র: পাকিস্তানি সৈন্যরা আপনাদের গ্রামে আক্রমণ করেছিলো কি ?
উ: হ, করছিলো।

প্র: আপনাদের এই গ্রামে কখন পাকিস্তানি বাহিনী আক্রমণ করলো ?
উ: আক্রমণ অনেক বার করছে। একদিন ভোরে আইসে চরম আক্রমণ করছিলো। তামাম গ্রাম হেরা ঘেরাও করছিলো। তামাম গ্রাম ঘেরাও করে ওরা পুরুষ মানুষ কাউক বাঁচাবার দেয় নাই। পুরুষ মানুষ কেউ পলাইতে পারে নাই। সবাক নিয়া যায়া ওরা মাইরে ফেলাইছে।

প্র: সেদিন আপনাদের গ্রামে পাকিস্তানি সৈন্যরা আর কি করেছিলো ?
উ: কাউক ডাক দিয়া নিয়া গেছে, কারু বাড়িতে আগুন লাগায় দিছে, কাউক মাইরে ফেলছে। মাইয়া মাইনষের ইজ্জত মারছে। কোনো অবস্হায় ওদের সাথে পারা যায় না। মোরা যে পাকেই দৌড়ে যাই সেই পাকেই খান, সে পাকেই মেয়ে মাইনষেক ওরা জাবড়ায়ে ধরে, সব পাকেই মেয়ে মাইনষেক ওরা ধরাধরি করছে। কোনো কিছু করি পারা যাই নাই। খানেদের হাতোত থিকা মোরা বাঁচপার পারি নাই কেউ। পুরুষ মানুষ সব ধরি নিয়া যায়া মাইরা ফালাইলো। ঐ সময় গ্রামে ব্যাটা ছেলে যা আছিলো হগলকেই ওরা মাইরে ফালাইছে। খানরা গেছে পর মোরা সবাই দৌড় মাইরে যায়া দেখি সবাই মইরা গেছে। মোরা ওইহানে গেছি পর খানরা ফির উল্টি আইছে। যখন ওরা উল্টি আইছে সখন ফির মোরা দৌড় মাইরেছি। মোর তিনটা ভাই ওই সময় মারা গেছে। যায়ে দেখি সব মরছে। তিনটা ভাই। ভাইয়ের বড় ব্যাটা, মোর বড় ব্যাটা। গাও গেরামের হগলকে এক জায়গায় নিছিলো খানরা। তারপর গুলি করছে।

প্র: আপনারা যখন লাশ আনতে গেলেন তখন পাকিস্তানি সৈন্যরা আবার ঘুরে এসে আপনাদেরকে ধাওয়া করছিলো।
উ: হ, ফির আসছিলো। আইসা ধাওয়া করছে।

প্র: তখন আপনি কি করলেন ?
উ: ফির দৌড় মাইরে এদিক ওদিক গেছি। কৈ গেছি সেটা এখন কওয়ার পারমু না। ফির আইসা দেখি ওরা সব মইরে গেছে। মোর স্বামী কইছিলো মুক পানি খিলাও। মুই পানিডাও খিলাইতে পারি নাই। তহনই ওই খানরা আইছে, মুই আবার দৌড় মারিছি। পরে আইসা দেখি স্বামী মোর মরছে।

প্র: আপনার পরিবারের কয়জনকে পাকিস্তানি সৈন্যরা হত্যা করেছিলো ?
উ: দুইজনাক নিয়া গেছিলো। মোর ব্যাটা আর স্বামী।

প্র: খানরা আর আসেনি এখানে ?
উ: কত অ্যালো আবার। দৌড়াদৌড়ি, কতো কেলেংকারী। ওরা আইছে, মোরা ভাতের পাতিল থুয়ে পলাইছি, ছালন (তরকারি) থুয়ে পলাইছি, খাওনও হয় নাই। ওরা খুব অত্যাচার কইরছে এই জায়গাত। খুব অত্যাচার। মোর ভাই খানগোরে দুধ দিয়া আইছে। মোর ভাই কতো কি দিছে। ফল দিয়া আইছে, কলা দিয়া আইছে, গাই দিলো, মুরগি দিলো, সব দিলো। হেরা তারপরও সবাক মারি ফেলালো। মেয়ে ছেলের ইজ্জত মারিলো। মোর তামাম জীবনটাই মাটি করি দিছে।

প্র: খানদের আপনারা মুরগি, দুধ, গরু-বাছুর দিয়েছেন ?
উ: হয়, হয়। বাঁচার জন্য মোরা দিছি। তাও মারিছে সোনা, তাও মারিছে। মোর ভাই বালটি ভইরে দুধ দিয়ে আইছে ৫/৭ জন মানুষের। তাও সবাক মাইরে ফেলছে।

প্র: পাকিস্তানি সৈন্যরা মহিলাদের উপর নির্যাতন করেছিলো কি ?
উ: হ, করছিলো। বেবাক মেয়েছেলেক ধরছিলো। ধরে আমাগো বাড়িত, এর ওর বাড়িত নিয়া গেছিলো। ঘরত আর আড়াল টাড়ালে নিয়া গেছিলো। ঘরত সান্ধাইয়া হেরা অত্যাচার করছিলো। ওগুলা করা শেষ হলি পর বাড়িত আগুন লাগায়ে দিছিলো। তখন সারা গাও শুইদ্ধে আগুন। খুব অত্যাচার করছিলো, খুবই অত্যাচার।

প্র: খানেরা কোনো মেয়েকে গুলি করে মারছিলো কি ?
উ: হ, মারিছে দুইজনকে।

প্র: তাদের নাম বলতে পারবেন ?
উ: ছয়না এক জনের নাম। আরেক জনের নাম সালু। হেরা হামার ঘরেত কানতেছিলো।

প্র: তারপরে আপনারা কি করলেন ?
উ: খানরা গেছে পর আইসে কান্দেছি। মরাগুলাক আশপাশের গ্রামের লোকরা নিয়া আইছে। মরাগুলাক গোছল করাইছে না করাইনি তা কওয়ার পারি না। মুই বেহুসের মতো। মোর তিনটা ভাই। ভাইয়ের ব্যাটা, মোর বড় ব্যাটা, স্বামী, সব এক জায়গাত মাটি দিছে।

প্র: তারপর ?
উ: এখানেই ছিলাম।

প্র: এরপর কি আর আসে নাই খানরা ?
উ: আসে নাই মানে ? আইছে। তহন দৌড়াদৌড়ি করি লুকাইছি।

সাক্ষাৎকার গ্রহণের তারিখ : নভেম্বর ০৪, ১৯৯৬
সংগ্রহ: সামহোয়ারইন ব্লগ থেকে

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

জনপ্রিয় পোস্টসমূহ