১৪ আগস্ট, ২০০৮

অভ্যুত্থান চলাকালেই কিসিঞ্জার খবর পাচ্ছিলেন, বঙ্গবন্ধু তখনো বেঁচে

সমকাল (১৩ আগস্ট ২০০৮) পত্রিকায় বিভিন্ন গোপন দলিলে প্রাপ্ত তথ্য নিয়ে অজয় দাশগুপ্তের একটি মূল্যবান লেখা প্রকাশিত হয়েছে। এতে বঙ্গবন্ধু হত্যাকালীন সময়ে আমেরিকার পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরী কিসিঞ্জার ও তার স্টাফ অফিসারদের কথোপকথনের কিছু ব্যাখ্যা রয়েছে। আন্তর্জাতিক রাজনীতির অজানা কাহিনী সমৃদ্ধ এই লেখাটি সংগ্রহ করা হয়েছে সমকাল পত্রিকা থেকে।

অভ্যুত্থান চলাকালেই কিসিঞ্জার খবর পাচ্ছিলেন, বঙ্গবন্ধু তখনো বেঁচে
৭৫ এর ট্রাজেডি মার্কিন দলিলে

অজয় দাশগুপ্ত

[যে কোনো বৃহৎ শক্তির কূটনৈতিক কর্মকান্ডে বিস্তর লিখিত দলিল চালাচালি হয়। আর এতে থাকে আপাতভাবে তুচ্ছ থেকে শুরু করে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার আনুপূর্ব বিবরণ। তাৎক্ষণিক প্রয়োজন তো আছেই, আরেকটি উদ্দেশ্য ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য শিক্ষণীয় রেখে যাওয়া। বাংলাদেশের ১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্ট ট্র্যাজেডি যুক্তরাষ্ট্রের কাছে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল। বঙ্গবন্ধু হত্যা-কান্ডে তাদের সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ সুবিদিত। এর সত্যতা অনুসন্ধানে গবেষকরা নিরন্তর চেষ্টা চালা-চ্ছেন। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দফতরের শত শত দলিলে ওই সময়ের ঘটনাবলির রয়েছে লিখিত বিবরণ। ঘটনার ৩০ বছর পর অতি গোপনীয় ও গোপনীয় নথি প্রকাশের বিষয়ে আইন প্রণয়নের কারণে এসব দলিল এখন শুধু ওই দেশের নাগরিক নয়, বিশ্ববাসীও জানতে পারছে। তবে নথি প্রকাশ করার আগে তা পর্যালোচনা-পরীক্ষা করে দেখবেন অরিজিনেটিং এজেন্সির প্রধান। তিনি যদি কোনো বিষয় প্রকাশ না করার সিদ্ধান্ত দেন তবে তা অনির্দিষ্টকাল আলোর মুখ দেখবে না। ১৫ আগষ্ট ট্র্যাজেডির সঙ্গে প্রত্যক্ষ সংশ্লিষ্টতা ছিল তৎকালীন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জারের। এখনো তিনি বেঁচে আছেন। তাই গোপনীয় ও অতি গোপনীয় হিসেবে চিহ্নিত মার্কিন পররাষ্ট মন্ত্রণালয়ের দলিল প্রকাশের আগে তার মতামত নেওয়া হয়েছে এবং তিনি বেশকিছু দলিল সংশোধিত আকারে প্রকাশের সিদ্ধান্ত দিয়েছেন। আর এ কারণেই বাংলাদেশের ইতিহাসের বিয়োগান্ত ও সুদূরপ্রসারী তাৎপর্যপূর্ণ অধ্যায়ের কিছু অংশ আপাতত থেকে যাচ্ছে অন্ধকারে। কে জানে, হয়তোবা চিরকালের জন্যই।]

১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্ট। শুত্রক্রবার। ওয়াশিংটন সময় সকাল ৮টা। বাংলাদেশে তখন ১৫ আগষ্ট, রাত ১০টা। এদিন প্রত্যুষে বাংলাদেশের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সামরিক অভ্যুত্থানে নিহত হয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার তার স্টাফ সভায় বসেছেন কয়েকজন কর্মকর্তা নিয়ে। এখানে কী আলোচনা হয়েছে তার বিবরণ
পররাষ্ট্র দফতরের অনেক দলিলে, যার সংশোধন করা হয়েছে। অর্থাৎ পূর্ণ বিবরণ আপাতত জানার অবকাশ নেই।
বৈঠকের শুরুতেই কিসিঞ্জার বলেন, আমরা এখন বাংলাদেশ প্রসঙ্গে কথা বলব।
নিকট প্রাচ্য ও দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী আথারটন : এটা হচ্ছে সুপরিকল্কিপ্পত ও নিখুঁতভাবে বাস্তবায়ন করা অভ্যুত্থান।
কিসিঞ্জার : মুজিবুর কি জীবিত না মৃত?
আথারটন : মুজিব মৃত। তার অনেক ঘনিষ্ঠ সহচর, পরিবারের সদস্য, ভাই, ভাগ্নে নিহত হয়েছেন।
কিসিঞ্জার : আমি ব্যুরো অব ইন্টেলিজেন্স অ্যান্ড রিসার্চ (আইএনআর) থেকে ভালো পরামর্শ পেয়েছি [তিনি এ কর্মকর্তার সঙ্গে ওয়াশিংটনে আগেই কথা বলেছেন। তবে এটা ফোনে নাকি সরাসরি, সেটা স্পষ্ট নয়]।
হিল্যান্ড (ব্যুরো পরিচালক) : আমি যখন আপনার সঙ্গে কথা বলেছি তখন তিনি মৃত ছিলেন না।
কিসিঞ্জার : আচ্ছা? তারা কি কিছু সময় পর তাকে হত্যা করেছে?

এ আলোচনা থেকে স্পষ্ট, ১৫ আগষ্ট অভ্যুত্থান চলাকালেই কিসিঞ্জার অবহিত হচ্ছিলেন [১৫ আগষ্ট ঢাকার যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাস প্রেরিত বার্তায় বলা হয় : ঢাকার সময় বিকেল চারটা পর্যন্ত দেখা যায়, অভ্যুত্থান সফল হচ্ছে বলেই প্রতীয়মান হয়। কোনো সক্রিয় প্রতিরোধ দেখা যাচ্ছে না]।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের স্টাফ বৈঠকে কিসিঞ্জারের প্রথম প্রশ্নও সন্দেহ সৃষ্টি করে। তিনি প্রথমেই জানতে চেয়েছেন, মুজিব জীবিত নাকি মৃত। এ ধরনের ঘটনায় প্রথম প্রশ্ন হওয়ার কথা, মুজিব ক্ষমতায় আছেন কি নেই। কিন্তু প্রভাবশালী মার্কিন নেতা জানতে চেয়েছেন, বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি বেঁচে আছেন কি-না। ১০ ঘণ্টা আগে অভ্যুত্থান চলাকালেই তিনি ঘটনার বিবরণ পাচ্ছিলেন হিল্যান্ডের কাছ থেকে। এ অভ্যুত্থান রোধে তাদের কিছু করণীয় প্রতিকারের কথা ভাবেননি। বরং যেন মনে হয়, তিনি অপেক্ষা করে ছিলেন একটি দেশের রাষ্ট্রপতির মৃত্যু সংবাদের জন্য!

বাংলাদেশের স্থপতির প্রতি কিসিঞ্জারের বিরাগ ছিল ১৯৭১ সাল থেকেই। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওই বৈঠকে তিনি মুজিব সম্পর্কে যে মন্তব্য করেছিলেন তাতেও ওই বিদ্বেষের প্রতিফলন : হি ওয়াজ ওয়ান অব দ্য ওয়ার্ল্ড’স প্রাইজ ফুলস।
১৯৭৪ সালের ৩০ অক্টোবর কিসিঞ্জার এসেছিলেন বাংলাদেশে। তিনি বৈঠক করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে। এ সফরের মাত্র তিনদিন আগে ২৭ অক্টোবর অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ পদত্যাগ করেন। মুক্তিযুদ্ধকালে দেশের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালনকালে তিনি চমকপ্রদ দক্ষতা ও যোগ্যতার স্বাক্ষর রাখেন। তাকে অপসারণের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের চাপ ছিল বলে ধারণা করা হয়। কিসিঞ্জাসের সফরের প্রাক্কালে তাকে অপসারণ কাকতালীয় নাকি এর পেছনে কোনো বিশেষ কারণ ছিল, সেটা ইতিহাসের গবেষণার বিষয় হতে পারে। তাজউদ্দীনের অনমনীয় মনোভাবের কারণে একাত্তর সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্বপ্ন বিসর্জন দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও পাকিস্তানের পরিকল্পনা মেনে নেওয়ার জন্য খন্দকার মোশতাকের চক্রান্ত সফল হতে পারেনি।
১৯৭৪ সালের বন্যার পরপরই দেশে দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। এ সময়ে খাদ্যের ঘাটতি ছিল ব্যাপক এবং তা পহৃরণে যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে বাংলাদেশ সহায়তা চাইছিল।
কিসিঞ্জার বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে বৈঠকে বলেন, ‘আপনার তো দেখছি চারদিক থেকেই সমস্যা।’
বঙ্গবন্ধু বন্যা সমস্যা, খাদ্য সমস্যা, রাসায়নিক সারের ঘাটতি, জনসংখ্যা বৃদ্ধি, পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পদ বণ্টন এবং বাংলাদেশের বিভিন্ন শিবিরে অবস্থানকারী পাকিস্তানি নাগরিকদের তাদের দেশে ফিরিয়ে নেওয়ার প্রসঙ্গ তুললে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী সম্ভবত ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করেই ‘আপনার তো দেখছি চারদিক থেকেই সমস্যা’ বলেছিলেন। কারণ বৈঠকে তোলা প্রতিটি বিষয়েই তার অবস্থান ছিল বাংলাদেশের বিপক্ষে।
কিসিঞ্জারের বাংলাদেশ সফরের কিছুদিন আগে বঙ্গবন্ধু জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে ভাষণ দিয়েছিলেন। ওই সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জেরাল্ড ফোর্ডের সঙ্গে তার বৈঠক হয়। কিসিঞ্জারের সঙ্গে ঢাকায় আলোচনাকালে বঙ্গবন্ধু ফোর্ডকে বাংলাদেশ সফরের আমন্ত্রণ জানিয়ে বলেন, তিনি ভারতে তার আসন্ন সফরের সঙ্গে মিল রেখে ঢাকা আসতে পারেন। এর জবাবে কিসিঞ্জারের মন্তব্য ছিল কূটনৈতিক শিষ্টাচারের পরিপন্থী। তিনি ঢাকায় বঙ্গবন্ধুকে বলেন, ‘ফোর্ড ভারত সফরের সময়ে বাংলাদেশে আসতে পারেন। তবে আমরা মনে করি না বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের তরফে ভারতের অনুমতি গ্রহণের প্রয়োজন রয়েছে।’
কিসিঞ্জার ওয়াশিংটনে ফোর্ডের সঙ্গেও বঙ্গবন্ধুর বৈঠকের প্রসঙ্গ তোলেন। তিনি বলেন, প্রেসিডেন্ট আপনার সঙ্গে আলোচনায় সন্তুষ্ট। ণড়ঁ নধসনড়ড়ুষবফ যরস! এ বাক্যের অর্থ হতে পারে, আপনি তাকে মুগ্ধ করেছেন। আবার, আপনি তাকে কথার জাদুমালা আর ব্যক্তিত্ব দিয়ে ভুলিয়েছেন বলেও ধরে নেওয়া যায়। কিন্তু ধুরন্ধর কূটনীতিক যদি নধসনড়ড়ুষবফ শব্দের আক্ষরিক অর্থ ‘প্রতারণা’ বুঝিয়ে থাকেন?
ঢাকার বৈঠকে বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কাছে বাংলাদেশের ন্যায্য পাওয়ার প্রসঙ্গ তোলেন। তিনি বলেন, আমরা সম্পর্ক স্থাপনের জন্য অনেক কিছু করেছি। যুদ্ধবন্দিদের ছেড়ে দিয়েছি। পাকিস্তানের বৈদেশিক সম্পদের দায়দেনার যতটা আমাদের ওপর বর্তায় তা বহনের কথা জানিয়েছি। কিন্তু পাকিস্তান কেবল কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনে আগ্রহী।
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দফতর যে গোপনীয় দলিল সংশোধন করে প্রকাশ করেছে তাতে দেখা যায়, কিসিঞ্জার এ প্রশ্নে পাকিস্তানের বক্তব্যই তুলে ধরেছেন। তিনি বলেন, আমি পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আজিজ আহমদের সঙ্গে কথা বলেছি। তিনি দায়দায়িত্ব গ্রহণের বিষয়ে আপনাদের অনাগ্রহের কথা জানিয়েছেন।
প্রধানমন্ত্রী মুজিব : আমি ইতিমধ্যেই দায়দায়িত্ব গ্রহণ করেছি। আমরা এ বিষয়ে ঋণদাতাদের সঙ্গে চুক্তি করেছি। কিন্তু কেন আমি সম্পদের ভাগ পাব না?
মুজিব : আমরা এক বা দুই বছর খাদ্য সহায়তা চাই। আমি দেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করার জন্য ব্যাপক সহায়তা চাই। আমরা শিল্পের কাঁচামাল চাই। আমাদের পাটের জন্য ভালো দাম চাই।
এর জবাবেই কিসিঞ্জার বলেন, আপনার তো দেখি চারদিক থেকেই সমস্যা।
বঙ্গবন্ধু চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক স্থাপনে আগ্রহের কথাও বলেন। এ প্রসঙ্গে কিসিঞ্জারের বক্তব্য : তারা হয়তো আপনাদের সঙ্গে পাকিস্থানের সম্পর্ক স্থাপন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে চাইবে।

হ্যাঁ, পাকিস্তান বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছিল ১৫ আগষ্ট বঙ্গবন্ধুকে নৃশংসভাবে হত্যার পর। চীনও সম্পর্ক স্থাপন করে এ বিয়োগান্ত ঘটনার পর।
কিসিঞ্জার কি ১৫ আগষ্টের ঘটনা আগেই জানতেন?
বঙ্গবন্ধু বন্যায় খাদ্যশস্য বিনষ্ট হওয়া এবং বিশ্ববাজারে খাদ্যের দাম অনেক বেড়ে যাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে সাহায্য চাইলে কিসিঞ্জার বলেন, ‘আমাদের সমস্যা হচ্ছে, আমাদের কাছে উদ্বৃত্ত খাদ্য নেই। ... সাহায্য প্রসঙ্গে আমাদের কংগ্রেসের সঙ্গেও সমস্যা রয়েছে। আগামী মঙ্গলবার আমাদের কংগ্রেসের (প্রতিনিধি পরিষদ ও সিনেট) নির্বাচন। তবে ১৯৭০ সালে আপনি যেভাবে জিতেছিলেন তেমন সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রশাসন আশা করে না।
জবাবে বঙ্গবন্ধু রসিকতা করে বলেন, ‘নির্বাচনে অত বেশি আসন পাবেন না। আপনারা জানেন, আমি বিপুলভাবে জয়ী হওয়ার পর কী ঘটেছিল : পাকিস্তানিরা এখানে সবকিছু ধ্বংস করে দেয়। আমাকে গ্রেফতার করে। আমার পাঁচ বছরের ছেলেও বলে, আর নির্বাচনে দাঁড়াবে না।’
এর জবাবে কিসিঞ্জার বলেন, ‘আপনি নিশ্চয়ই কিছু সময়ের জন্য আপনার দেশে নির্বাচন এড়াতে চাইবেন না!’
বঙ্গবন্ধু যে কোনো সময়েই নির্বাচন এড়াতে চাননি সেটা কিসিঞ্জার সম্ভবত জানতেন না।
১৫ আগষ্ট ওয়াশিংটনের সকালের বৈঠকে ফিরে তাকানো যাক।
বৈঠকে আথারটন জানান, অভ্যুত্থানকারীরা মুজিবকে হত্যার জন্যই এসেছিল। তারা বাড়িটি ঘেরাও করে এবং ভেতরে গিয়ে তাকে মেরে ফেলে।
আগেও তাকে হত্যার চক্রান্ত প্রসঙ্গ তুলে কিসিঞ্জার বলেন : তাকে কি গত বছর আমরা এ বিষয়ে কিছু বলিনি?
আথারটন : গত মার্চে এ বিষয়ে আমরা অনেক ইঙ্গিত পাচ্ছিলাম।
কিসিঞ্জার : তাকে কি আমরা কিছু জানাইনি?
আথারটন : তাকে সে সময়ে জানিয়েছি।
কিসিঞ্জার : কারা এর পেছনে, সে বিষয়ে কি মোটামুটি কিছু ধারণা দিয়েছি?
আথারটন : কারা জড়িত সেসব নাম তাকে বলেছি কি-না, সেটা পরীক্ষা করে দেখতে হবে।
হিল্যান্ড : আমরা এ বিষয়ে ঠিক যথাযথ ধারণা দিইনি।
আথারটন : তিনি বিশ্বাস করেননি। তিনি বলেছেন, কেউ তাকে এ ধরনের কিছু করবে না।
বাংলাদেশের অভ্যুত্থান ‘সফল’ হওয়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দফতরের কাছে খবর পৌঁছে যায় : ‘যারা অভ্যুত্থান করেছে তাদের মধ্যে রয়েছে সামরিক অফিসার, মধ্য পর্যায় ও সিনিয়র অফিসার- যাদের সাধারণভাবে পূর্ববর্তী শাসকদের তুলনায় কম ভারতপন্থি, সোভিয়েতবিরোধী এবং মার্কিনপন্থি হিসেবে গণ্য করা যায়।
কিসিঞ্জার : এটাই হতে হবে।
আথারটন : তারা দেশের নাম পরিবর্তন করে ইসলামী প্রজাতন্ত্র রেখেছে।
কিসিঞ্জার : তারা যুক্তরাষ্ট্রপন্থি হবে, এটা অপরিহার্য নয়। প্রকৃতপক্ষে পথপরিক্রমায় তারা চীনাপন্থি এবং ভারতবিরোধী হবে বলে আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি। আমি সবসময়ই জানতাম, ভারত বাংলাদেশকে স্বাধীন করার জন্য একদিন অনুতাপ করবে। এ ভবিষ্যদ্বাণী আমি একাত্তর সালেই করেছি।
আথারটন : আমাদের বড় সমস্যা হবে বাংলাদেশের নতুন শাসকদের সঙ্গে খুব ঘনিষ্ঠতা বা মাখামাখি পরিহার করা।
কিসিঞ্জার : কেন তারা আমাদের প্রতি বন্ধুভাবাপন্ন বলে?
ঝানু কূটনীতিক কিসিঞ্জার ঠিকই বুঝেছিলেন স্বাধীন দেশের স্থপতিকে সপরিবারে হত্যার মধ্য দিয়ে যারা রাষ্ট্রক্ষমতায় এসেছে তারা তাদের বন্ধু এবং বৈঠকেই তিনি জানিয়ে দেন : ‘তারা আমাদের কাছ থেকে বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ পাবে। আমরা তাদের স্বীকৃতি দেব।’
১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্ট বাংলাদেশ তার ইতিহাসের কঠিনতম পথে যাত্রা শুরু করে। এর পেছনে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা ছিল ৩০ লাখ শহীদের রক্তে অর্জিত বাংলাদেশের জনগণের জন্য অগ্রহণযোগ্য এবং অবশ্যই ক্ষতিকর। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দফতরের যেসব গোপনীয় দলিল প্রকাশ করা হচ্ছে, তা থেকেও এ সাক্ষ্য মেলে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

জনপ্রিয় পোস্টসমূহ