সংগ্রহ করা হয়েছে সামহোয়ারইনব্লগ থেকে।
লিখেছেন: রাশেদ
নিচের লেখাটি Century of Genocide: Eyewitness Accounts and Critical Views By Samuel Totten, William S. Parsons and Israel W. Charny (New York: Garland Publishing, 1997) বইয়ের দশম চাপ্টার (পৃ. ২৯১-৩১৬) থেকে অনুবাদ করা ও সংক্ষেপিত। এই চাপ্টারের নাম Eyewitness Accounts: Genocide in Bangladesh by Rounaq Jahan.
এই চাপ্টারে একাত্তরের গণহত্যার বেশ কিছু সাক্ষীর কথা বলা হয়েছে। প্রথম দুই অংশে ২৫ শে মার্চ কালো রাতে ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে ঘটে যাওয়া হত্যাকান্ডের সাক্ষী দুইজনের কথা বলা হয়। একজন ছিলেন জগন্নাথ হলের ছাত্র আর অন্যজন বুয়েটের একজন টিচার। ৩য় ও চতুর্থ সাক্ষী বর্ণনা দেন পাকিস্তানিদের নারী নির্যাতনের। আর পঞ্চম সাক্ষী এক গ্রামে ঘটে যাওয়া কিছু নিরপরাধ কিশোর হত্যার কিছু বিবরন তুলে ধরেন। আর শেষ সাক্ষীর কথা থেকে বিহারীদের কিছু তান্ডবলীলার কথা জানা যায়।
জগন্নাথ হলের হত্যাকান্ড
এই অংশটুকু নেয়া হয়েছে রশিদ হায়দারের এডিট করা “১৯৭১: ভয়াভয় অভিজ্ঞতা” (ঢাকা, জাতীয় সাহিত্য প্রকাশনী, ১৯৮৯) বইয়ের কালি রঞ্জনশীলের “জগন্নাথ হলে ছিলাম ” অধ্যায় থেকে (পৃ. ৫)।
আমি দক্ষিন ব্লকের ২৩৫ নাম্বার রুমে ছিলাম। ২৫ তারিখ রাতে গোলাগুলি আর বোমা-শেল ফাটার শব্দে আমার ঘুম ভেঙ্গে যায়। হতভম্ব হয়ে চিন্তা করছিলাম কি করা যায়। তারপর আমি ছাত্র সংসদের জেনারেল সেক্রেটারি সুশীলের কাছে যাবার জন্য ক্রল করে ৪র্থ তলায় উঠলাম। তার রুমে আরো কিছু ছেলে এরই মধ্যে এসে পড়েছিল কিন্তু সুশীল তখন রুমে ছিল না। ছাত্ররা আমাকে বলল ছাদে যেতে যেখানে আরো বেশ কিছু ছেলে আশ্রয় নিয়েছিল। কিন্তু আমি (হয়ত কিছুটা স্বার্থপরের মত) ভাব্লাম নিজের মত করে থাকি; আর তাই চতুর্থ তলার উত্তর কোনার দিকে চলে গেলাম আস্তে আস্তে ক্রল করে। জানাল দিয়ে আমি দেখছিলাম আর্মিরা সার্চলাইট দিয়ে ছাত্রদের খোঁজে রুমে রুমে তল্লাশি চালাচ্ছিল। আর খুঁজে পেলেই তাদেরকে শহীদ মিনারের কাছে নিয়ে যেয়ে গুলি করছিল। পাকিস্তানি আর্মিরা মাঝে মাঝেই মর্টার ব্যবহার করছিল হলের দিকে তাক করে। অ্যাসেম্বলির সামনের টিন শেড আর উত্তর ব্লকের বেশ কিছু রুমে আগুনও ধরিয়ে দেয় তারা।
কিছু সময় পরে ৪০-৫০ জন পাকিস্তানি আর্মি দক্ষিণ ব্লকে আসে আর ডাইনিং রুমের জানালা ভেঙ্গে ভিতরে প্রবেশ করে। আর লাইট জ্বালিয়ে যেসব ছাত্র সেখানে আশ্রয় নিয়েছিল তাদের উপরে গুলি বর্ষণ করে। আর্মিরা যখন সেই রুম থেকে বের হয়ে আসে, তখন তারা হলের কেয়ারটেকার প্রিয়নাথদাকে মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে বিভিন্ন রুমের দিকে নিয়ে যাচ্ছিল। সেই সময়ে আমি তাদের দেখতে পারছিলাম না কারন আমি বাথরুম থেকে বের হয়ে ৪র্থ তলার সানশেডে লুকিয়েছিলাম। কিন্তু গোলাগুলির শব্দ, ছাত্রদের আহাজারি আর আর্মিদের ভাংচুরের শব্দ ঠিকই শুনতে পাচ্ছিলাম।
আর্মিরা চলে গেলে আমি আবার বাথরুমে এসে লুকাই। জানালা দিয়ে দেখতে পেলাম সলিমুল্লাহ হলেও আগুব জ্বলছে। শহরের উত্তর আর পশ্চিমাংশও জ্বলছিল।
সকাল বেলাতে ছাত্রদের গলার আওয়াজ পেয়ে আমি বের হই। দেখি কিছু ছাত্র প্রিয়নাথদার মৃতদেহ বয়ে নিয়ে যাচ্ছে নিচের দিকে আর আর্মিরা তাদের পাহারা দিচ্ছে। আর্মিরা আমাকেও বলে ছাত্রদের সাহায্য করার জন্য। হল থেকে মৃতদেহগুলো নিয়ে নিয়ে আমরা বাইরের মাঠে জড়ো করছিলাম। সেই সময়ে আমরা কয়েকজন ছিলাম ছাত্র, কয়েকজন মালি, গেট রক্ষকের দুই ছেলে আর বাকিরা ছিল পয়পরিস্কারকারী। পয়পরিস্কারকারীরা আর্মিদের বলল যে তারা তো বাঙ্গালি না, তাদের যেন যেতে দেয়া হয়। আর্মিরা তাদের আমাদের কাছ থেকে আলাদা করে নেয়। আর্মিরা সারাক্ষণ আমাদের লাথি মেরেছিল আর চিৎকার করছিল “"We will see how you get free Bangladesh! Why don't you shout Joy Bangla”। আমাদের তিনটি গ্রুপে ভাগ করে আমি যেই গ্রুপে ছিলাম সেটাকে নিয়ে তারা ইউনিভার্সিটির কোয়ার্টারে যায় আর পাঁচ তলার সবগুলো রুম চেক করে এবং মূল্যবান জিনিসপত্র সব লুট করে। নিচের তলায় আমরা স্তপ করে রাখা মৃতদেহ দেখেছিলাম বেশ কিছু।
ফিরে আসার পরে আমাদের দিয়ে মৃতদেহগুলো শহীদ মিনারে নিয়ে আগে থেকেই সেখানে রাখা আরো অনেক মৃতদেহের সাথে জড়ো করায়। আমার সাথী ও আমি যখন সুনীলদার (হলের গার্ড) মৃতদেহ বয়ে নিচ্ছিলাম তখন পাশের বস্তি থেকে মহিলাদের চিৎকার শুনতে পাই। আর্মিরা ঐসময়ে পয়পরিস্কারকারীদের উপরে গুলিবর্ষণ করছিল। আমি বুঝলাম যে আমাদেরও সময়ে এসেছে কারন যারা আমাদের আগে লাইনে ছিল তাদেরকে একসারিতে দাড় করিয়ে আর্মিরা গুলি করছিল। আমি ঐসময়ে দেখেছিলাম ড. দেবের (ফিলোসফি বিভাগের প্রফেরস) মৃতদেহ। আমি তখন ওনার মৃতদেহের পাশে শুয়ে পড়ি সুনীলদার লাশ ধরে থাকা অবস্থায় আর গুলির অপেক্ষায় থাকি। কিছুক্ষণ পরে চোখ মেলে দেখি তারা সবাই চলে গেছে।
তারপর আমি যাই পাশের বস্তিতে। সেখানে ইদু ভাই (পুরান বই বিক্রেতা) আমাকে অভয় দেন। তারপর পুরান ঢাকা হয়ে নদী পার হয়ে (মাঝি টাকা নেন নাই) শিমুলিয়া, নওয়াবগঞ্জ হয়ে আমি এপ্রিলের মাঝামাঝি সময়ে বরিশালে আমার গ্রামে চলে আসি।
এতে সদস্যতা:
মন্তব্যগুলি পোস্ট করুন (Atom)
জনপ্রিয় পোস্টসমূহ
-
মুহাম্মদ কামারুজ্জামান থাকেন রাজধানীর মিরপুর সাংবাদিক আবাসিক এলাকার ৪ নম্বর সড়কের ১০৫ নম্বর বাড়িতে। সাপ্তাহিক সোনার বাংলার সম্পাদক হিসেবে ত...
-
এ এম রিয়াছাত আলী সমকাল প্রতিবেদক আশাশুনি ও শ্যামনগর উপজেলা নিয়ে গঠিত সাতক্ষীরা-৩ আসন থেকে চারদলীয় জোট প্রার্থী হয়েছেন জামায়াত নেতা এএম রিয়াছ...
-
মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস এক দীর্ঘকালীন সংগ্রামের ইতিহাস। অসংখ্য রাজনৈতিক সামাজিক সংগ্রামের ঘটনা এক দীর্ঘ ধারাবাহিকতা শেষে নতুন দেশের জন্মের মাধ্...
-
বিদেশী বন্ধুদের জন্য সম্মানা ক্রেস্ট মুক্তিযুদ্ধে অনন্য অবদান রাখার জন্য বিদেশী বন্ধুদের সম্মাননা দেওয়া হবে। মানুষের চেতনায় লেখা হয়ে যাব...
-
আবদুল কাদের মোল্লা থাকেন রাজধানীর বড় মগবাজারের জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের পাশে গ্রিনভ্যালি অ্যাপার্টমেন্টে। তাঁর বিরুদ্ধে একাত্তর...
-
মাওলানা হাবিবুর রহমান চুয়াডাঙ্গা প্রতিনিধি দামুড়হুদা, জীবননগর ও চুয়াডাঙ্গা সদর নিয়ে গঠিত চুয়াডাঙ্গা-২ আসনে এবার চারদলীয় জোটের প্রার্থী জামায়...
-
১৬ ডিসেম্বরের পর বিভিন্ন দৈনিকে আত্মগোপনকারী মওলানা মান্নানকে ধরিয়ে দেবার আবেদন প্রকাশিত হয়। ০৭-০৫-১৯৭২ দৈনিক আজাদে প্রকাশিত মওলানা মান্নানক...
-
আবদুল খালেক মণ্ডল নিজস্ব প্রতিবেদক, সাতক্ষীরা এবারো সাবেক জামায়াত এমপি আবদুল খালেক মণ্ডল সাতক্ষীরা-২ আসন (সদর) থেকে চারদলীয় জোটের মনোনয়ন পেয়...
-
শান্তি কমিটি গঠনের সূত্রপাত। টিক্কা খানের সাথে বৈঠকরত ১২ জন রাজনৈতিক নেতার সমন্বয়ে গঠিত প্রতিনিধি দলের নেতা নুরুল আমিন ও গোলাম আযম। দৈনিক পূ...
-
লিখেছেন: সবাক আমাদের মুক্তিযুদ্ধে মিডিয়ার একটা ভূমিকা ছিলো। কখনও তা আমাদের পক্ষে গেছে আবার কখনও বিপক্ষে। ইলেক্ট্রনিক্স মিডিয়ার তখন এত সহজ...
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন